কিউএস র্যাংকিংয়ে পেছাচ্ছে ঢাবি-বুয়েট;এগোচ্ছে এনএসইউ-ব্র্যাক
নিজস্ব প্রতিনিধি বুধবার সন্ধ্যা ০৭:০৭, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১
দেশে শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বিদ্যাপীঠই প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানসম্মত শিক্ষা ও গবেষণার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুনাম কুড়িয়েছে। বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত অনেক অর্জনও রয়েছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দুটির ভাণ্ডারে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে করা কোয়াককোয়ারেল সাইমন্ডসসহ (কিউএস) স্বীকৃত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর র্যাংকিংয়ে ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছে ঢাবি ও বুয়েট। যদিও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এখন এদিক থেকে উন্নতি করছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দুটি বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে অচিরেই ঢাবি ও বুয়েটকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টদের অনেকে।
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চশিক্ষার মান ও পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে অনেক দিন ধরেই। শিক্ষকদের গবেষণায় অনাগ্রহ, ল্যাবগুলোর আধুনিকায়ন না হওয়া, অপর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ ও সুশাসনের অভাবসহ নানা সংকটে ভুগছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ঢাবি ও বুয়েটের র্যাংকিংয়ে অধোগতিতেও মূলত এসব বিষয়ই প্রভাব ফেলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যদিকে গত কয়েক দশকে হালনাগাদকৃত পাঠ্যক্রম, দক্ষ শিক্ষক ও উন্নত গবেষণাগারের সুবিধা নিয়ে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে ক্রমেই নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করে চলেছে এনএসইউ ও ব্র্যাকের মতো বেসরকারি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ যুক্তরাজ্যভিত্তিক কিউএসের র্যাংকিংয়েও এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। সংস্থাটির কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংস-২০২২ প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ঢাবি ও বুয়েটের অবস্থান যথাক্রমে ১৪২ ও ২০২তম। তিন বছর আগে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ে র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয় দুটির অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১২৭ ও ১৭৫তম। এ তিন বছরে র্যাংকিংয়ে ক্রমেই অবনমন ঘটেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দুটির। একই সময়ে উন্নতি করেছে বেসরকারি খাতের এনএসইউ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। কিউএস এশিয়া ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংস-২০১৯ প্রতিবেদনে এনএসইউ ও ব্র্যাকের অবস্থান ছিল ৩০১ থেকে ৩৫০তমের মধ্যে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে এনএসইউর অবস্থান ৮৬ ধাপ এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ২১৫তমে। একই সময়ে অন্তত ১০ ধাপ এগিয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২৯১-৩০০তমের মধ্যে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ ধারা চলমান থাকলে এনএসইউ ও ব্র্যাক সামনের বছরগুলোয় র্যাংকিংয়ে ঢাবি ও বুয়েটকে ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন কার্যক্রম রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং, কোয়ালিটি অ্যাশিউরেন্স (এসপিকিউএ) বিভাগের। বিভাগটির পরিচালক ড. মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে গবেষণার বিষয়টি অবহেলিত। এজন্য শিক্ষকদের মধ্যে গুণগত গবেষণা ও প্রকাশনার আগ্রহ অনেক কম। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র্যাংকিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের শিক্ষকদের গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণে বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে নানা রকম ততপরতা রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় এ চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কারণ র্যাংকিংয়ে অবস্থান যা-ই হোক, শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্য সুবিধাদি নিয়মিত পাবেন। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে র্যাংকিং নিয়ে নানাভাবে সচেতন করার চেষ্টা করছি।
আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, বিদেশী শিক্ষার্থী, সাইটেশন, শিক্ষক-নিবন্ধ অনুপাত, বিদেশী শিক্ষক, প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম, চাকরির বাজারে সুনাম, পিএইচডিধারী শিক্ষকসহ বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে র্যাংকিংয়ে অবস্থান নির্ধারণ করেছে কিউএস। এর মধ্যে কোনো কোনোটিতে এরই মধ্যে ঢাবি ও বুয়েটকে ছাড়িয়ে গিয়েছে এনএসইউ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
র্যাংকিংয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এনএসইউর উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে দেশের উচ্চশিক্ষা খাতে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে এনএসইউ। কিউএস র্যাংকিংসে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় ধারাবাহিকভাবে সম্মানজনক স্থান লাভ করে আসছে এনএসইউ। মানসম্মত শিক্ষা ও গুণগত গবেষণার মাধ্যমে অনেক আগেই দেশের বেসরকারি খাতের সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেতাব পেয়েছে এনএসইউ। বর্তমানে দেশসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেতাব অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এরই মধ্যে কয়েক সূচক ও বিষয়ে আমরা দেশের অন্য সব প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। আশা করছি এ ধারাবাহিকতায় একসময় দক্ষিণ এশিয়ার সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে এনএসইউ।
কিউএসের সর্বশেষ প্রকাশিত সূচকে দেখা গেছে, বিদেশী শিক্ষার্থী ক্যাটাগরিতে ১০০ পয়েন্টের সূচকের মধ্যে ঢাবি ১ দশমিক ৪, বুয়েট ১ দশমিক ৫, ব্র্যাক ৬ দশমিক ২ ও এনএসইউ ৯ দশমিক ৭ পেয়েছে। এ চার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিদেশী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঢাবি ও বুয়েটের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে এনএসইউ ও ব্র্যাক। একইভাবে বিদেশী শিক্ষক ক্যাটাগরিতেও বেসরকারি দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় পিছিয়ে ঢাবি। এ ক্যাটাগরিতে ১০০ পয়েন্টের সূচকে ঢাবি ৩ দশমিক ৮, ব্র্যাক ৫ দশমিক ১ ও এনএসইউ ৪৪ দশমিক ৭ পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারে সুনামের ক্ষেত্রে ঢাবি ও বুয়েটের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে এনএসইউ। এ ক্যাটাগরিতে ১০০ পয়েন্টের সূচকে এনএসইউর স্কোর ৬১ দশমিক ৯। এছাড়া ঢাবি ৫৮ দশমিক ৪, বুয়েট ৪৮ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি ৪১ দশমিক ২ স্কোর অর্জন করেছে। আর পিএইচডিধারী শিক্ষক ক্যাটাগরিতে বুয়েটের স্কোর ২ দশমিক ৪, এনএসইউর ২ এবং ঢাবি ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির স্কোর ১ পয়েন্ট করে।
র্যাংকিংয়ে ক্রমাবনতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবির উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, শুধু র্যাংকিংয়ে অবস্থান দিয়ে যেমন ঢাবিকে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়, তেমনি আমরা সব সূচকে সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারছি সেটিও সত্য নয়। আমি মনে করি, শতবর্ষের পথচলায় ঢাবির এমন কিছু অর্জন ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি রয়েছে, যা দেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই। আবার শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কলেবর বড় হওয়ায় কিছু বিষয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব বা মনোযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে চাকরির বাজারে আমাদের সব গ্র্যাজুয়েট আশানুরূপ দক্ষতা দেখাতে পারছেন না। পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে ধরতে না পারায় বিদেশী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমাবেশ ঘটছে না। তবে এ বিষয়গুলো নিয়ে আমরা ভাবছি। সে আলোকে কিছু পদক্ষেপও নেয়া হচ্ছে।
কিউএসের পাশাপাশি টাইমস হায়ার এডুকেশন ও সিমাগো-স্কপাসের ইনস্টিটিউশন র্যাংকিংয়েও ক্রমান্বয়ে অবনতি ঘটছে ঢাবি ও বুয়েটের।
তবে আন্তর্জাতিকভাবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো র্যাংকিং পরিচালনা করে, তাদের কিছু মানদণ্ড দেশের প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ। ঢাবির ইতিহাসের এ অধ্যাপক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন বিদেশী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী রয়েছেন তারা সেটা বিবেচনায় নেন। বিদেশী শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বিষয়টি বিবেচনায় নিলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনিতেই পিছিয়ে পড়বে। কারণ আমাদের দেশের বেতন কাঠামোয় বিদেশী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব না। অন্যদিকে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এসে কোনোমতে পড়ে সনদ নিয়ে যাচ্ছেন। সে সূচকে তারা এগিয়ে যায়। তবে গবেষণা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। বিলম্বে হলেও এখন ক্রমান্বয়ে তারা সচেতন হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী এক দশকে এ চিত্র আরো অনেকটা বদলাবে।