ত্রাণ বিতরণকালে আত্মপ্রচারই প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি
নিজস্ব প্রতিনিধি রবিবার দুপুর ০৩:৫৯, ৩ মে, ২০২০
একরামুল ইসলাম, পীরগাছা (রংপুর)প্রতিনিধি: করোনা ভাইরাসের কারণে গোটা দেশ যখন অবরুদ্ধ। জরুরী প্রয়োজন ছাড়া বাড়ি থেকে কেউই বের হচ্ছেন না। চলমান এই পরিস্থিতিতে কর্মহীন হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কাজে যেতে না পারায় আয়ও বন্ধ হয়ে গেছে তাদের। খাদ্য সংকটে পড়েছে খেটে খাওয়া দুস্থ ও ছিন্নমুল পরিবারের লোকজন। এমন কর্মহীন অসহায় মানুষদের সহায়তায় সরকারি ত্রাণ যখন অপ্রতুল। তখন ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে এদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষসহ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণ নিতে সংকোচ বোধ করেন তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অথচ ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা অমান্য করে নিজেকে প্রচার করতে বেশি ব্যস্ত ত্রাণদানকারীরা। এমনকি অনেকেই সরকারি ত্রাণ নিজের নামে বিতরণ করছেন।
এখানে সরকারি কোনো ভূমিকাই রাখছে না সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধিরা। বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতা, সরকারি কর্মকর্তা ও সামাজিক সংগঠন জনসম্মুখে ত্রাণ বিতরণ করে তার ছবি ও ভিডিও করে রাখছে। অনেকেই মানুষের বাসা-বাড়িতে গিয়ে ত্রাণ দিলেও ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করছেন। এতে সামাজিকভাবে বিব্রত হচ্ছেন করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা। আবার একটি মাস্ক বিতরণকালে অনেকেই ফটোসেশনে দেখা যাচ্ছে। এতে বিব্রতবোধ করছেন ত্রাণগ্রহণকারী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে জনপ্রতিনিধিসহ সামর্থ্যবান সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই আলোকে দেশের সব জেলায় বিশেষ বরাদ্দও দেওয়া হয়েছে। গত ২ এপ্রিল পর্যন্ত আট হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল ও চার কোটি ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন ফান্ড থেকে মাঠ প্রশাসনে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরাদ্দ অব্যাহত রেখেছে সরকার। স্
থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অনুদানও অব্যাহত আছে। তবে এসব অনুদান বিতরণের ক্ষেত্রে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ছবি তোলা বা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা যেন বাধ্যতামূলক হয়ে পড়েছে। রাতের বেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিতে গিয়েও আত্মপ্রচারে ছাড় দিচ্ছেন না অনেকে। উপজেলা পর্যায়ে গভীর রাতে ত্রাণ দিতে গেলেও গণমাধ্যমকর্মীদের নিয়ে যাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তারা। আবার ওই ত্রাণ পৌঁছে দেওয়ার ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের সাফল্য হিসাবে প্রচার করছেন তারা। স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান ও রাজনৈতিক দলের নেতারাও পিছিয়ে নেই। অসহায় মানুষের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছেন কেউ কেউ। অনেকেই আবার যাকে সাহায্য দিচ্ছেন তারা নাম ঠিকানাসহ প্রচার করছেন। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন নিম্নআয়ের মানুষ। সামাজিক মর্যাদার কথা বিবেচনা করে অনেকেই ত্রাণ নিতে চাচ্ছেন না। নিজের কাঁধে বা মাথায় করে খাবার বস্তা বা ব্যাগ নিয়ে ওই ছবি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করছেন অনেক কর্মকর্তা। বিভিন্ন জেলা, উপজেলার ফেসবুক পেজ গ্রুপে বা আইডিতে ঢুকলে এমন অসংখ্য ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাবে যা কেবলমাত্র নিজেদের সাফল্য প্রচারের জন্যই তৈরি করা হয়েছে।
এমন বেশকিছু কন্টেইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। ভাইরাল হওয়া ত্রাণ বিতরণের বিভিন্ন ছবি ভিডিও নিয়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে যারা ত্রাণ দিচ্ছেন তারাও এর পেছনে নানা যুক্তি দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, কাউকে ছোট করার জন্য ছবি তোলা হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, সরকার যে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তা বোঝানোর জন্য অনেক সময় প্রচার করতে হয়। এসব প্রচার না হলে সরকার যে মানুষকে সাহায্য করছে তা বোঝা যাবে না। রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা মূলত দলীয় প্রধান, মন্ত্রী, এমপি, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মরিয়া হয়ে ত্রাণ বিতরণের ছবি বা ভিডিও করে থাকেন। তাদের ভাষ্য, দলীয় প্রধান বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যাতে তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত থাকেন এজন্য ছবি তুলতে হয়। এছাড়া এসব ছবি ও ভিডিও নেতাকর্মীদেরও সংগঠনের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করে। সরকারি কর্মকর্তা বা জনপ্রতিনিধি ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে আত্মপ্রচারের হিড়িক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজনরা। এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশে হয়ে থাকে। ত্রাণ বিতরণকালে ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা মোটেই ঠিক নয়।
একদিকে যেমন ত্রাণগ্রহণকারী বিব্রত হয়। অপরদিকে সামাজিক অবক্ষয়ও বটে। আমাদের ধর্মে আছে একহাতে দান করলে যেন অন্যহাত না জানে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার জেসমীন প্রধানকে কয়েক দফা ফোন করা হয়েছিল। তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।