“ব্লু হোয়েল’ গেম খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশি তরুনীর মৃত্যু?
আরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার দুপুর ০১:২৭, ১২ অক্টোবর, ২০১৭
যা দাবী করা হচ্ছে
“ব্লু হোয়েল (Blue Whale) গেম খেলার ফলে একজন বাংলাদেশি তরুণী মৃত্যুবরণ করেছে।”
দাবীটি: অপ্রমাণিত
মূল উৎপত্তি
৫ অক্টোবর, ২০১৭ তারিখ, বৃহস্পতিবার, ঢাকার সেন্ট্রাল রোডের নিজ বাসায় ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায়, অপূর্বা বর্মণ স্বর্ণা নামের ১৩ বছরের এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঘটনার ২ দিন পর, ৭ অক্টোবর টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে কিশোরীর পিতা, অ্যাডভোকেট সুব্রত বর্মণ সন্দেহ প্রকাশ করেন যে ‘ব্লু হোয়েল (Blue Whale)’ গেম খেলার পরিণতিতেই তার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশের পরপরই দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকাসহ বিভিন্ন বেনামি নিউজ পোর্টালগুলো শুধুমাত্র পিতার এই সন্দেহের উপর ভিত্তি করে কোনরূপ যাচাই-বাছাই ছাড়াই ‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলার পরিণতিতেই কিশোরীটি আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে।
‘ব্লু হোয়েল’র শিকার হয়েছে এমন সন্দেহ প্রকাশ করার পেছনে সুব্রত বর্মণ যে লক্ষণগুলো প্রকাশ করেন তা হলো―
১) তার মেয়ে একা ছাঁদে যেতো, ২) রাত ৩টায়ও মোবাইলে ব্যবহার করতে দেখেছেন এবং ৩) “No one is responsible for my death” স্মাইলি ইমোটিকন ব্যবহারসহ এরূপ সুইসাইড নোট সে রেখে গিয়েছে।
অথচ ব্লু হোয়েল গেমটির যেসকল বিশেষ লক্ষণের দাবী অনলাইনে বিভিন্ন পোস্টে করা হয় (যেমন, নিজ শরীরের বিভিন্ন অংশে কাটাকাটি করা, নিজের পরিচিত জনদের ক্ষতি করা ইত্যাদি) সেসবের কোনটির আলামতই মেয়েটির ক্ষেত্রে পাওয়া যায় নি। এমন কি তার মোবাইলেও এমন গেমের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। কিশোরীর পিতা যে সকল আলামতের উপর ভিত্তি করে এই দাবীগুলো করেছেন সেসবের কোনটিই বিশেষভাবে ব্লু হোয়েলের আলামত না।
দৈনিক যুগান্তর ‘ব্লু হোয়েল’র নির্দেশে তরুণীর আত্মহত্যা শিরোনামে একটি খবরে প্রকাশ করে―
“ভয়ংকর মরণনেশা ‘ব্লু হোয়েল’ এবার আঘাত করেছে বাংলাদেশে।
অথচ এই দাবীর পেছনে কোন পুলিশী তদন্ত নয়, বরং সুব্রত বর্মণের সন্দেহই মূল ভিত্তি। যিনি নিজেই গেমটির সম্বন্ধে জেনেছেন তার মেয়ের মৃত্যু পর, সাক্ষাৎকার প্রদানের ঠিক আগের দিন। তার জানার উৎসও হচ্ছে অনলাইনে প্রচারিত প্রমাণ ও ভিত্তিহীন বিভিন্ন পোস্ট। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়―
“(দুই বছর পূর্বে) ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে। হলিক্রস স্কুলে ভর্তির পর থেকে বদলে যেতে থাকে সে। পড়াশোনার জন্য সে ব্যবহার শুরু করে ইন্টারনেট। কয়েক বছর আগে থেকেই অ্যানড্রয়েড মোবাইল ফোনও ব্যবহার শুরু করে স্বর্ণা। ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার চলছিল। এরই মধ্যে সবার অজান্তে সে ঢুকে পড়ে ইন্টারনেটের এক নিষিদ্ধ গেমসে।”
অর্থাৎ, স্বর্ণার অস্বাভাবিক আচরণ শুরু হয় ব্লু হোয়েল গেমটি নিয়ে নিয়ে অনলাইন হাইপ তৈরি হওয়ার অনেক পূর্বেই এবং সবার অজান্তে এই নিষিদ্ধ গেমসে ঢুকে পরার দাবীটিও সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসূত, যেহেতু এরূপ কোন অনলাইন খেলায় কিশোরীটি অংশগ্রহণ করেছে এমন কোন আলামত বা প্রমাণ পাওয়া যায় নি। রিপোর্টটিতে আরও বলা হয়―
“তার লাশের পার্শ্ব থেকে ব্লু হোয়েলের কিউরেটরের নির্দেশ মতো লিখে যাওয়া একটি চিরকুটও উদ্ধার করা হয়। তা এখন পুলিশের হাতে। তাতে বড় করে লেখা, আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়। লেখা শেষে গেমসের নির্দেশনা মতো একটি হাসির চিহ্ন আঁকা।”
আত্মহত্যার সময় সুইসাইড নোটে “আমার আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নয়” এমন কিছু লিখে যাওয়া বা হাসির চিহ্ন (ইমোটিকন) আঁকা বিশেষভাবে ব্লু হোয়েল শিকার হওয়া কিশোরদের ক্ষেত্রেই নয় বরং আত্মহত্যাকারীদের ক্ষেত্রে খুবই সাধারণ ঘটনা। ঘটনাটি শুধুমাত্র রোহমর্ষকভাবে তুলে ধরার জন্যই ব্লু হোয়েলের ‘কিউরেটরের’ নির্দেশ মতো লিখে যাওয়া কথাটি রিপোর্টটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও গেমটির সম্পর্কে সুব্রত বর্মণের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করা তথ্যেও রয়েছে একাধিক ভুল তথ্য। এসবের একটি হচ্ছে, “রাশিয়ার এক সাইকিস্ট সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এই গেমটি উদ্ভাবন ও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিয়েছে।” গেমটির উদ্ভাবক হিসেবে রাশিয়ায় ২০১৬ সালে গ্রেফতারকৃত ফিলিপ বুদেইকিন মনোবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলো, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সে কোনরূপ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছিলো না।
যুগান্তরের রিপোর্টটিতে ব্লু হোয়েল আসক্তদের চেনার উপায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়―
যেসব কিশোর-কিশোরী ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে তারা সাধারণভাবে নিজেদের সব সময় লুকিয়ে রাখে। স্বাভাবিক আচরণ তাদের মধ্যে দেখা যায় না। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা কাটিয়ে দেয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। থাকে চুপচাপ। কখনও আবার আলাপ জমায় অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে। গভীর রাত পর্যন্ত ছাদে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেককে। একটা সময়ের পর নিজের শরীরকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলতে থাকে তারা।
অথচ এই আলামতগুলো বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে এমন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অন্য বিভিন্ন স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক কারণেও দেখা যেতে পারে। এসব এককভাবে ব্লু হোয়েলের লক্ষণ হতে পারে না।
ব্লু হোয়েল: কোন মোবাইল গেম নয়
বিভিন্ন সংবাদে ‘ব্লু হোয়েল’ সম্পর্কিত তথ্য ও ঘটনা বর্ণনায় এটি স্বচ্ছ হয় যে ব্লু হোয়েল সম্পর্কে যথাযথ গবেষণা না করেই রিপোর্টগুলো তৈরি করা হয়েছে এবং রিপোর্টকারীদের কেউই ইন্টারনেট কিভাবে কাজ করে কিংবা ডিপ ওয়েবের মত টার্মগুলোর সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখে না। এদের অধিকাংশেরই তথ্যসূত্র অনলাইনে প্রকাশিত বিভিন্ন গুজব সংবাদ বা ভিডিও। সাধারণত, গেম অর্থ আমরা যেমন মোবাইল বা কম্পিউটার গেম বুঝি ‘ব্লু হোয়েল’ এমন কোন গেম না। বিভিন্ন ইউটিউব ভিডিওতে এটিকে একটি মোবাইল গেম হিসেবে যেভাবে রোমঞ্চকরভাবে উপস্থাপন করা হয়, বিষয়টি বাস্তবে মোটেও ঠিক এরূপ নয়।
ব্লু হোয়েল মূলত একটি টাস্ক লিস্ট ভিত্তিক গেইম। অর্থাৎ, অংশগ্রহণকারীদের এই খেলায় বিভিন্ন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। এক গেইমটি সর্বপ্রথম পরিচালিত হয় রাশিয়া ভিত্তিক ‘ভিকে’ নামক সোশ্যাল মিডিয়া ওয়েবসাইটে F57 নামক একটি গ্রুপের মাধ্যমে। এক সাক্ষাতকারে গ্রুপটির প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ বুদেইকিন F57-এর মানে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটি খুব সাধারণ। F এসেছে আমার নামের প্রথম থেকে আর 57 এসেছে আমার তখনকার ফোন নাম্বারে শেষ ডিজিট থেকে”। এই গ্রুপের সদস্যদের গ্রুপ চ্যাটের মাধ্যমে এসব কাজগুলো করতে উদ্বুদ্ধ করা হতো বলে জানা যায়। অবশ্য পরবর্তীতে এই গ্রুপটি সোশ্যাল মিডিয়া সাইটটির কর্তৃপক্ষ ব্যান করে দেয়।
বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারিত হ্যাকাররা মোবাইলের ভেতর গেমটির মাধ্যমে বা বিভিন্ন লিংক ব্যবহার করে চিরস্থায়ীভাবে ঢুকে যাওয়ার এমন দাবীগুলো কল্পনাপ্রসূত। এই গেইমের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারীদের হিপটোনাইজ করে আত্মহত্যা বা আত্মঘাতী কাজে বাধ্য করা হয় না। এই ধরণের গ্রুপগুলো আত্মহত্যাকে উৎসাহ দিলেও এই গেমের মাধ্যমে রাশিয়ায় ১৩০ জনকে সরাসরি আত্মহত্যায় বাধ্য করা হয় এমন দাবী সমর্থন করে এমন কোন প্রমাণ মেলে নি পুলিশী কোন অনুসন্ধানে। বয়ঃসন্ধিকাল পার করছে এমন কিশোর-কিশোরীদের অনেকেরই আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি সাধনের করার প্রবণতা থাকে। এই গেইমের মাধ্যমে গ্রুপে এমন মানুষদের নিয়ে আনা হয় যারা আত্মহত্যা করার ইচ্ছা পোষণ করে এবং তাদের কাছে আত্মহত্যাকে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে রোমাঞ্চকরভাবে তুলে ধরা হয় মাত্র।
এই গেমটি উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর কিংবা খুব ভয়ানক হ্যাকারদের দ্বারা পরিচালিত কোন গেম না বরং ‘ট্রুথ অর ডেয়ার’-এর মত চ্যালেঞ্জভিত্তিক একটি খেলা। তাই এই খেলার কোন ওয়েবসাইট নেই, গোপন লিংক নেই বা ভয়ঙ্কর কোন হ্যাকার গ্রুপের হাত নেই। এটি চকিং গেইম (দম বন্ধ করে অজ্ঞান হওয়া) এর মত খেলাগুলোর মতই একটি বিকৃত খেলা যেটি কিছু গ্রুপ অসুস্থ বিনোদনের লক্ষ্যে খেলে থাকে। কিছু ব্লগ, ট্যাবলয়েড পত্রিকা, ইউটিউব চ্যানেল, নিউজ পোর্টাল, ফেইসবুক পেইজ কেবল ভাইরাল খবর প্রচারের লক্ষেই ব্লু হোয়েলের খবরগুলোকে রসিয়ে উপস্থাপন করে থাকে, কেবল বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বব্যাপী ব্লু হোয়েল নিয়ে মিডিয়ার গুজব একই ধরণের। এই গেইমের অস্তিত্ব অপ্রমাণিত এবং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
ব্লু হোয়েলের মত আত্মঘাতী ক্রীড়াগুলোকে প্রতিহত করতে ব্রাজিল ভিত্তিক একটি গ্রুপ পিংক হোয়েল নামক একটি চ্যালেঞ্জের প্রচলন করে যার মাধ্যমে মানুষদের ইতিবাচক ও মানসিকভাবে সহায়ক কিছু কাজ করতে উৎসাহ প্রদান করা হয়।
ব্লু হোয়েলকে জাল খবরের রোমাঞ্চকর উপস্থাপন বলে অভিমত দেয়। বুলগেরিয়া ভিত্তিক একাধিক সংগঠন ব্লু হোয়েলের গুজব বিশ্বাস না করার জন্য সতর্কতা প্রদান করে।
আরও জানতে
Pink Whale – http://baleiarosa.com.br
তথ্যসূত্র
- Mikhail Grachev. “Administrator of “Death groups”: A sincere recognition”. saint-petersburg.ru. (নভেম্বর ১৫, ২০১৭). ((In Russian))
- “Choking game”. Wikipedia.
- Justin W. Patchin. “Blue Whale Challenge”. Cyberbullying Research Center. (মে ১৬, ২০১৭).
- Anne Collier. “‘Blue Whale’ game: ‘Fake news’ about teens spread internationally”. NetFamilyNews. (মার্চ ১৩, ২০১৭).
- “Advice for those concerned about the ‘Blue Whale’ story”. UK Safer Internet Centre. (এপ্রিল ২৭, ২০১৭).
- Mariya Cheresheva. “Bulgarians Warned Against Believing ‘Suicide Game’ Stories”. balkaninsight. (ফেব্রুয়ারী ২২, ২০১৭).