বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের শাহাদাত বার্ষিকী আজ
মেঘনা নিউজ ডেস্ক বৃহস্পতিবার রাত ০২:৪০, ২০ আগস্ট, ২০২০
১৯৭১ সালের এই দিনে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন তিনি।
মতিউর রহমান পাকিস্তানের করাচির মশরুর বিমান ঘাঁটি থেকে একটি প্রশিক্ষণ বাহিনী নিজের করায়ত্তে নিয়ে দেশে আসার সময় সেটি বিধ্বস্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন। ভারতীয় সীমান্তের ৩৫ মাইল দূরে থাট্টায় উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল থেকে প্রায় আধা মাইল দূরে পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধে মতিউরের অসম সাহসিকতা ও অতুলনীয় অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে সর্বোচ্চ জাতীয় খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
মতিউর রহমান ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রোডের “মোবারক লজ”-এ জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। যা এখন মতিনগর নামে পরিচিত। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ৬ষ্ঠ। তার বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকশনসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।
১৯৬৩ সালে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে পাইলট অফিসার হিসেবে কমিশন লাভ করেন। কমিশন প্রাপ্ত হবার পর তিনি করাচির মৌরিপুর (বর্তমান মাসরুর) এয়ার বেজ এর ২ নম্বর স্কোয়ার্ডন এ জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এখানে তিনি টি-৩৩ জেট বিমানের উপর কনভার্সন কোর্স সম্পন্ন করেন এবং ৭৫.৬৬% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি এফ-৮৬ স্যাবর জেট এর উপরেও কনভার্সন কোর্স করেন এবং ৮১% নম্বর পেয়ে উর্ত্তীর্ণ হন। বৈমানিক কনভার্সন কোর্স এ ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে তাকে পেশোয়ারে (১৯ নং স্কোয়ার্ডন) এ পোস্টিং দেয়া হয়।
১৯৬৫ তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু’বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।
১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫ মার্চের কালরাতে তিনি ছিলেন নরসিংদীর রায়পুরার রামনগর গ্রামে৷ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন৷ যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকলেন ৷ তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করা অস্ত্র দিয়ে গড়ে তোলেন প্রতিরোধ বাহিনী। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই,পি,আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এফ-৮৬ স্যাবর জেট থেকে তাদের ঘাঁটির উপর বোমাবর্ষণ করে৷ মতিউর রহমান পূর্বেই এটি আশঙ্কা করেছিলেন৷ তাই ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পান তিনি ও তার বাহিনী৷
এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকা আসেনও ৯ মে সপরিবারে করাচি ফিরে যান৷ কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাকে তখন বিমানের সেফটি অফিসারের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো। তিনি বিমান দখলের জন্য ২১ বছর বয়সী রাশেদ মিনহা্জ নামে একজন শিক্ষানবীশ পাইলটের উড্ডয়নের দিন (২০ই আগস্ট, ১৯৭১) টার্গেট করেন। তার পরিকল্পনা ছিলো মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ারের অনুমতি পেয়ে গেলে তিনি তার কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নেবেন। পরিকল্পনা অনুসারে অফিসে এসে শিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে চলে যান রানওয়ের পূর্ব পাশে৷
সামনে দুই সিটের প্রশিক্ষণ বিমান টি-৩৩। পাইলট রাশেদ মিনহাজ বিমানটি নিয়ে দ্বিতীয় বারের মত একক উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর মিনহাজ বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলেন। মিনহাজ বিমানটি থামান এবং ক্যানোপি (জঙ্গি বিমানের বৈমানিকদের বসার স্থানের উপরের স্বচ্ছ আবরন) খুলে বিমান থামানোর কারণ জানতে চান।
এসময় মতিউর রহমান বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন তিনিসহ বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে। বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে থাকায় কেউ দেখতে না পেলেও কন্ট্রোল টাওয়ার মিনহাজের বার্তা শুনতে পায় এবং রাডারে বিমানের অবস্থান বুঝে অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু আসন্ন জেনেও মতিউর রহমান বিমানটি নির্ধারিত সীমার নিচে চালিয়ে রাডার কে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের আসার চেষ্টা করেন।
প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছে যাওয়া অবস্থায় রাশেদ মিনহাজ জ্ঞান ফিরে পান এবং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা করেন। রাশেদ চাইছিলেন, মতিউর রহমানের বিমান ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা সফল হওয়ার চেয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত করা ভালো। এ সময় রাশেদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পড়েন। বিমানটি কম উচ্চতায় উড্ডয়ন করার ফলে একসময় রাশেদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সাথে প্যারাসুট না থাকায় তিনি নিহত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোর বিমান ঘাটি তারঁ নামে নামকরণ করা হয়েছে। বিমান বাহিনী তার নামে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষনে সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শনকারীকে এটি প্রদান করা হয়।
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া