ঢাকা (সকাল ১০:৫১) শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ ইং

স্বাধীনতা যুদ্ধের গল্প-সামশাদ এস খানম

<script>” title=”<script>


<script>

চিরদিনের জন্য চলে যাচ্ছে নিশি। এ বাড়িতে আর ফেরা হবে না। কখনো পা দুলিয়ে বসা হবে না দোলনাটাতে, ‘আম্মিজান’ বলে ডাকা হবে না আয়শা বেগমকে। এমনকি অরুণের হাতে হাত রেখে গানও গাওয়া হবে না কখনো। ভাবতেই ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো।

নিশির কাছে ‘ভালোবাসা’ মানে খুব ভ্রান্তিকর একটা শব্দ। কবি-সাহিত্যিকরা যতই রঙচঙ মেখে একে রাঙাবার চেষ্টা করুক, আসলে ভালোবাসা হচ্ছে এক ধরণের শঠতা যার কিছুটা কিঞ্চিৎ মায়া আর বাকিটা প্রতারণা দিয়ে আবৃত যেটা ও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে!

গত প্রায় এক যুগ ধরে আয়েশা বেগম শয্যাশায়ী। বউ হয়ে এ বাড়িতে আসার আগে তথাকথিত পুত্রবধূদের মত শাশুড়ি আয়েশা বেগমের ব্যাপারে নিশিও মনে মনে বেশ আতংকগ্রস্থ ছিল। বাপের বাড়িতে এক গ্লাস পানি ঢেলেও খাওয়া হয়নি ওর। জীবনের একুশটা বছর সুখ আর স্বাচ্ছন্দ্য ছাড়া কিছুই বোঝেনি নিশি। তাই বিয়ের পর কেমন করে সংসার সামলাবে, কেমন করেইবা পক্ষাঘাতগ্রস্থ শাশুড়ির সেবা করবে এই ভাবনাতেই টালমাটাল অবস্থা।

মাকে জিজ্ঞেস করতেই বিশাল এক ধমক খেতে হল। এমনিতেই দেশের অবস্থা ভালো ঠেকছে না, তাই সদ্য যৌবনে পা দেয়া নিশিকে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই বিয়ে দিতে হচ্ছে। এখন মেয়ে যদি এসব কথা বলে তাহলে তা মোটেও ভালো লক্ষন নয়। তাই শাশুড়ির দেখভালে যেন বিন্দুমাত্র অবহেলা না হয় একথা পইপই করে মা ওকে বলে দিলেন।

লক্ষী মেয়ের মত অল্প কয়েকদিনেই আয়েশা বেগমকে নিজের মায়ের থেকেও বেশী ভালোবেসে ফেললো নিশি। আয়েশা বেগমও নিশিকে একদম চোখের আড়াল হতে দেন নি। মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মাস চারেক আগে চাকরীতে ঢুকেছে অরুণ। নতুন সংসারে শুধু ভালোবাসার অবগাহন!

হঠাত একদিন সকালে দুই বাচ্চা আর স্বামী কফিলউদ্দিনকে নিয়ে করাচি থেকে অরুণের বোন অণিমা হাজির। এসেই ঘোষনা দিল এবার অনেকদিন বাপের বাড়ি থাকবে সে। এতদিন পর অণিমাকে দেখে আয়েশা বেগম আর অরুণের খুশীর অন্ত নেই। কারণ কফিলউদ্দিনের ছুটি মঞ্জুর না হওয়াতে একমাত্র ভাইয়ের বিয়েতে অণিমা থাকতে পারেনি।

তবে প্রথম দিন থেকেই কেন জানি এই কফিলউদ্দিন লোকটাকে নিশির একদম ভালো লাগেনি। মুখভর্তি পানের রস সব সময় টুপটুপ করে। দু’চোখ ভরে সুর্মা দেয়া, কেমন একটা ধুর্ত চাহনি। আর সেই সাথে চোস্ত উর্দু ছাড়া একটা বাক্যও বলে না লোকটা। বাচ্চা দু’টোকেও বাংলা শিখানো হয়নি। শুধু তাই নয়, অণিমাকেও কফিলউদ্দিনের সাথে উর্দুতে কথা বলতে হয়। এর চেয়েও অদ্ভুত ব্যপার হল খুব ভোরে অফিসের নাম করে অণিমার স্বামী বের হয়ে যায় আর সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরে। কি নাকি জরুরী কাজে মাস খানেকের জন্য করাচি অফিস তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছে। কেমন একটা অস্বস্তিতে দিনগুলো কাটছিল নিশির। কিন্তু আয়েশা বেগম আর অরুণের ভালোবাসার কাছে ওর অস্বস্তিগুলো বার বার পরাজিত হচ্ছিল বলে কফিলউদ্দিনকে তেমন আমলে নিল না।

সেদিন ছিল ২২ মার্চ ১৯৭১ সাল, সোমবার। হঠাত দুপুরবেলা হন্তদন্ত হয়ে কফিলউদ্দিন হাজির। এসেই বললো, ‘জলদি তৈয়ার হো যাও। এক জরুরি অফিসিয়াল পিকনিক পে আভি যানা পারেগা’! অণিমা কয়েক মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে বাচ্চাসহ স্বামীর সাথে রওনা দিল। আয়েশা বেগম আর নিশি দু’জনেই খুব অবাক। কি এমন জরুরী পিকনিক যে কোনো ঘোষণা ছাড়াই এভাবে যেতে হবে। তাছাড়া অরুণ বাসায় নেই, ওকেই বা কি জবাব দিবে। কফিলউদ্দিন কারোর কোনো কথার উত্তর দিল না। বের হওয়ার আগে নিশির দিকে অশ্লীল ভঙ্গী করে বলে গেল, ‘ফির মিলেঙ্গে ভাবীসাহেবা! খুদা হাফিজ’!

অরুণ বাসায় ফিরে সব শুনে বেশ রাগারাগি করলো। দেশের পরিস্থিতি ভাল না, বাতাসে বিভিন্ন ধরণের খবর ভেসে বেড়াচ্ছে। এর মধ্যে কিসের পিকনিক, কেনইবা আয়শা বেগম ওদের যেতে দিলেন তা নিয়ে নিশিও এক প্রস্থ বকা খেল।

২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল, বৃহস্পতিবার। পুরো ঢাকা শহর জুড়ে কেমন যেন গুমোটভাব। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু কি ঘটতে যাচ্ছে তা কেউ জানে না। জনমানবের চোখেমুখে চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে। আয়শা বেগম বিছানায় শুয়েই মেয়ে, মেয়েজামাই আর নাতিদের জন্য ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছেন। নিশি কিছুক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কিছুক্ষণ হাত-পা টিপে দিল, তাও ভদ্রমহিলাকে শান্ত করতে পারলো না। ওর নিজের শরীরটাও ভালো লাগছে না বেশ কিছুদিন ধরে।

সন্ধ্যা নামতেই মেশিনগানের গোলাগুলি, আগুনের লেলিহান শিখা আর মর্টারের গোলায় একটু পর পর ঘরবাড়ি সব কেঁপে উঠতে লাগলো। নিশি আর অরুণ দৌড়ে আয়শা বেগমের রুমে ঢুকে উনার দু’হাত চেপে ধরে দু’আ পড়া শুরু করলো। এমন ভয়াবহ শব্দ আর এতই ঘুটঘুটে অন্ধকার যে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিল না। তিনজনই বুঝে গেছে আজই তাদের জীবনের শেষ রাত, আগামীকালের সূর্যোদয় আর দেখা হবে না কারোরই!

হঠাত একটানা দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ পেয়ে অরুণ ছুটে গিয়ে দরজার ওপাশ থেকে কফিলউদ্দিনের গলার স্বর শুনে দরজা খুলে দিল। নিশি কোনভাবে একটা মোমবাতি ধরিয়ে এগুতেই দেখলো অরুণের কানে কি জানি ফিসফিস করে বলছে কফিলউদ্দিন। অরুণ গায়ে চাদর জড়িয়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললো, ‘মাকে দেখে রেখো। আমি কাল-পরশুর মধ্যেই চলে আসবো। চিন্তার কিছু নাই, বাইরের কেউ এলে দরজা খুলো না’। নিশি কথা বলার কোনো সুযোগই পেল না। আধো আলো আধো ছায়াতে কফিলউদ্দিনকে দেখে ওর কাছে মনে হল এ যেন সাক্ষাৎ ইবলিস শয়তান! সবাই বের হয়ে যেতেই নিশি দরজা বন্ধ করে মোমবাতি নিয়ে শাশুড়ির রুমে ঢুকতেই দেখলো আয়শা বেগমের মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা দিয়ে থুতু-রক্ত বের হচ্ছে! পাগলের মত নিজের শাড়ি দিয়ে মুছে দিতে লাগলো।

এভাবেই কতটা সময় যে পার হয়েছে ওর মনে নেই। এত শব্দের মাঝে কখন যেন ক্লান্ত হয়ে নিশির চোখ মুদে আসছিল। আবার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে নিশি উঠে দাঁড়াতেই ওপাশ থেকে কফিলউদ্দিনের গলার শব্দ শুনতে পেল। কিছুতেই আজ দরজা খুলবে না ও। খানিক পরেই কফিলউদ্দিন বলে উঠলো, ‘ভাবীসাহেবা, অরুণ ভাইয়া কি তাবিয়াত বহুত খারাবি হ্যাঁয়। খুদা কি ওয়াস্তে দারওয়াজা খুল দিজিয়ে’!

অরুণের কথা শুনে নিশি আর স্থির থাকতে পারলো না। দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠলো, ‘কি হইছে অরুণের, কোথায় ও’? কফিলউদ্দিন দ্রুত দরজা বন্ধ করে নিশির চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে বেডরুমের দিকে নিয়ে গেল। ‘বহুত দিমাগ থি, হ্যা না?’, বলে নিমিষেই নিশির শাড়ি-ব্লাউজ সব খুলে ফেলে পাশবিক অত্যাচার শুরু করে দিল। উদ্বেগ-দুশ্চিন্তায় সারাদিন অনাহারী নিশি ততক্ষণে বাধা দেয়ার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। চারিদিকে মর্টারের শেলের আওয়াজ আরো বাড়তে লাগলো। এরপর নিশির নগ্ন দেহখানা টানতে টানতে শাশুড়ির রুমে নিয়ে গেল কফিলউদ্দিন। আয়শা বেগমের চোখের সামনে আবার অমানবিক নির্যাতন চললো নিশির উপর। ততক্ষনে আয়শা বেগম তার বাকশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছে।

অট্টহাসিতে ফেটে চিৎকার করে ইবলিসটা বলতে লাগলো, ‘আম্মিজান, আপকি বেটি বহুতই বেওকুফ হ্যাঁয়। লেকিন আজ জ্যাদা মাজা আয়া’! নিশির যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ভোর হয়ে গিয়েছে, ওর দুই উরুর মাঝখানটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে! শাড়ি দিয়ে কোনো রকম পেঁচিয়ে নিশিকে নিয়ে জিপগাড়িতে উঠালো কফিলউদ্দিন। এরপর এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে নিশির জায়গা হচ্ছিল আর প্রতিবারই কফিলউদ্দিনের সুর্মাচোখের সেই ক্রুরহাসি।

পাকিস্তানী হানাদারবাহিনী একটু একটু করে নিশির সকল সম্মান, লজ্জা, ভয়, অপমানবোধ শেষ করতে লাগলো। আস্তে আস্তে ওর উদর স্ফীত হতে দেখে ওরাও বুঝে গেল ও গর্ভবতী, নিশির কদরও কমতে লাগলো। ঠিকমত খাবার দিচ্ছে না, যখন খুশী তখন একেকজন এসে নিশির মুখে প্রস্রাব করে দিয়ে যাচ্ছে। এ এক চরম বিকলাঙ্গ পাশবিকতা।

প্রস্রাব-পায়খানা আর আবর্জনায় মাখামাখি নিশিকে বিহারী ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করলো মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা। ওদের কারো পা নেই, কারো দুই হাত নেই, কেউবা যুদ্ধে চক্ষু হারিয়েছে। গর্ভবতী বীরঙ্গনা নিশিকে দেখে ছেলেরা ঝরঝর করে কেঁদে দিল। ওদের কাছেই শুনতে পেল দেশ নাকি ক’দিন হল স্বাধীন হয়েছে। গোসল করিয়ে কিছুটা সুস্থ করে মুক্তিবাহিনীরই একজন আবিষ্কার করলো এ তো অরুণ ভাইয়ের স্ত্রী নিশি ভাবি!

কিন্তু অরুণের মত প্রগতিশীল চিন্তার মানুষও নিশিকে মেনে নিল না। ধর্ষিতা নারীকে মেনে নেয়া নাকি ওর পক্ষে অসম্ভব। আর গর্ভের এই শিশুর দায়ভার নেয়া নাকি আরো অমূলক! সেদিন অরুণের পাশে অণিমা আর ইবলিস কফিলউদ্দিনকেও দেখতে পেল। কেউই নিশিকে যেন চিনতে পারছে না। পাশের রুম থেকে আয়শা বেগমের গোঙানির আওয়াজই কেবল সকল সত্য ঘটনার সাক্ষী দিচ্ছিল!

কি সুন্দর ফুটফুটে পুত্রসন্তানের মা হয়েছে নিশি। অবিকল অরুণের মত দেখতে। বুকের বামপাশে ‘ব’ আকৃতির খয়েরী রঙের জন্মদাগও আছে। ঠিক এই জায়গাতে অরুণেরও একটা জন্মদাগ রয়েছে। ছেলের বুকের জন্মদাগ নিশিকে আবারও মনে করিয়ে দিল এক নতুন বাংলাদেশ বুকে নিয়েই বেঁচে থাকবে ওর সন্তান!

শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT