রোগীর স্বজন কর্তৃক হামলায় খুন ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাত ডা. রকিব
নিজস্ব প্রতিনিধি বুধবার রাত ১০:১৯, ১৭ জুন, ২০২০
মইনুল ইসলাম মিশুক, হোমনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধিঃ ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে খুলনায় খ্যাত ছিলেন রাইসা ক্লিনিকের পরিচালক ডা. মো. আব্দুর রকিব খান (৫৯)। ১৫ জুন রাত ৮টা ৫০ মিনিটের দিকে রোগীর মৃত্যুর ঘটনা কেন্দ্র করে স্বজনরা আর্তকিত হামলায় চালায় তারা ডা. রকিবকে লাথি, ঘুষি ও লাঠি দিয়ে আঘাত করে এতে তার মাথার পেছনে জখম হয় এমতবস্থায় তাকে প্রথমে গাজী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় সেখানে তার অবস্থার অবনতি হলে শেখ আবু নাসের হাসপাতালে প্রেরণ হয়। গুরুতর জখম অবস্থায় আইসিইউতে ভর্তি করা হয় চিকিৎসাধীন কালে মঙ্গলবার (১৬ জুন) সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়।
গল্লামারীতে তার মালিকানাধীন রাইসা ক্লিনিকেই কর্তব্যরত অবস্থায় তার উপর হামলা চালায় রোগীর স্বজনরা। যার ভিডিওফুটেজ এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। তিনি শুধু রাইসা ক্লিনিকের মালিক নন, বাগেরহাট মেডিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলের (ম্যাটস) অধ্যক্ষও ছিলেন। এছাড়া সিনিয়র এই চিকিৎসক বিসিএস স্বাস্থ্য প্রশাসনে পরিচালক পদমর্যাদায় চাকরি করতেন। করোনার আতঙ্ক উপেক্ষা করেও চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবসহ মরহুমের গুণগ্রাহীরা। তার মৃত্যুতে কাঁদছেন রোগীরাও। স্বজন-বন্ধু-শুভার্থীরাও কাঁদছেন। সবার চোখে পানি। তার কাছে কতভাবে ঋণী সবাই।
জনপ্রিয় এই চিকিৎসক গরিব রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধ দিতেন। দুস্থ-অসহায় মানুষের কাছে তিনি ছিলেন আপনজন। অনেক রোগীকে বিনামূল্যে এবং নামমাত্র মূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং ওষুধ দেওয়ার কারণে তাকে গরিবের ডাক্তার বলা হতো। একবার তার কাছে পৌঁছাতে পারলে অসহায় মানুষ নতুন করে প্রাণ পেত বেঁচে থাকার। সবার জন্য চিকিৎসা নিশ্চিতের প্রাণান্ত লড়াই ছিল তার শেষদিন পর্যন্ত। অথচ সেই রোগীদের স্বজনরাই সাদামনের এ মানুষটিকে পিটিয়ে হত্যা করলো।
গল্লামারী তার ক্লিনিকের পাশের রবিউল ইসলাম সবুজ নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, কোনো রোগী টাকা না দিতে পারলেও তাকে চিকিৎসা দিতেন ডা. রকিব। অপারেশনের মতো জটিল বিষয়েও কারও কাছে টাকা না থাকলে যা দিতো তাই দিয়েই অপারেশন করতেন। গরিব রোগীদের কাছে তিনি ছিলেন আপনজন। লোকে তাকে বলত ‘গরিবের ডাক্তার’। চেম্বারে রোগী ঢুকলেই যেভাবে সম্বোধন করে বসাতেন, সে ডাকে অর্ধেকটা ভালো হয়ে যেতেন অনেক রোগী। যে কারণে শহরের নিম্নআয়ের হতদরিদ্র মানুষ তার কাছে ছুটে যেত।
এদিকে ডা. রকিবের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে খুলনার চিকিৎসক সমাজে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তাকে নিয়ে অনেকেই শোকপ্রকাশ করছেন। হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান তার। খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি একরামুল হক হেলাল তার ফেসবুকে লিখেছেন বাগেরহাটে অবস্থিত ‘মেডিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’-এর অধ্যক্ষ, খুলনার গল্লামারীর ‘রাইসা ক্লিনিক’-এর মালিক গরিবের ডাক্তার রকিব জনৈকা রোগীর স্বজনদের হাতে নিহত হন।(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)!
তার মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে এই অঞ্চলের নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র শোকের ছায়া নেমে আসে। রাব্বুল আলামিন এই নিরহঙ্কারী পরোপকারী মানুষটাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। আমিন। এরকম শত শত মানুষ ডা. রকিবের প্রশংসা করে ফেসবুকে মন্তব্য লিখেছেন।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম বাহার বুলবুল বলেন, বুধবার (১৭ জুন) সকাল ৯টা পর্যন্ত ডা. রকিবের মৃত্যুর ঘটনায় কোনো মামলা বা আটক হয়নি। তবে পরিবার মামলা করবে বলে শুনেছি। এই বর্বরোচিত হামলা করে চিকিৎসক হত্যা করার ঘটনায় নিন্দা জ্ঞাপন এবং সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে বিবৃতি দিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) খুলনার সভাপতি ও সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. শেখ বাহারুল আলম, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. মেহেদী নেওয়াজসহ নেতারা। অনুরূপভাবে ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব)কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও খুলনা মেডিক্যাল কলেজ শাখার সভাপতি শেখ আখতার উজ জামান, সাধারণ সম্পাদক ডা. আবু জাফর মো. পারভেজ ও বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএইচসিডিওএ) খুলনা জেলা শাখার সভাপতি ডা. গাজী মিজানুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. সওকাত আলী লস্কর রোগীর স্বজন পরিচয়দানকারী সন্ত্রাসী হামলায় ডা. রকিবের মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর শোক ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
ডা. আব্দুর রকিব খান হত্যার প্রতিবাদে বুধবার (১৭ জুন) দুপুর ১২টায় বিএমএ জরুরি সভা ডেকেছে। দুপুর ১টায় বিক্ষোভ সমাবেশ। বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) দুপুর দেড়টায় সংবাদ সম্মেলন করবেন চিকিৎসকরা। নগরীর মোহাম্মদ নগরের পল্লবী সড়কের বাসিন্দা আবুল আলীর স্ত্রী শিউলী বেগমকে ১৪ জুন সিজারের জন্য রাইসা ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। ওইদিন বিকেল ৫ টায় অপারেশন হয়। বাচ্চা ও মা প্রথমে সুস্থ ছিলেন। পরে রোগীর রক্তক্ষরণ হলে ১৫ জুন সকালে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানের চিকিৎসকরাও রোগী রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে না পেরে ঢাকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকায় নেওয়ার পথে ১৫ জুন রাতে শিউলী বেগম মারা যান। ভিডিওফুটেজে দেখা যায় ১৫ জুন রাতেই এ ঘটনায় সম্ভাব্য হামলাকারী রোগীর স্বজন কুদ্দুস, আরিফ, সবুরসহ কয়েকজন নারী। ডা. মো. আব্দুর রকিব খান এর মৃত্যুতে হোমনা উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারি সার্জন ডা. এম.এম. মাহবুবুর রহমান(৩৯তম)ও ডা.লুৎফুন নাহার নিবির সহ সকল চিকিৎসকগণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেছেন এবং ডা. রকিব হত্যার দোষীদের কঠিন শাস্তিসহ দ্রুত বিচার দাবি জানিয়েছেন।