পিংকি সু স্টোর এখন শুধুই স্মৃতি চারিদিক স্তব্ধ বাকরুদ্ধ সেই পিংকি
নিজস্ব প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার রাত ১০:০৮, ৩০ জানুয়ারী, ২০২০
মোঃ জাকির হোসেন,জেলা প্রতিনিধি,মৌলভীবাজারঃ মৌলভীবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৫ গ্যাসের রাইজার থেকে আগুনের সূত্রপাত বিয়ে বাড়ি এখন হয়েছে মৃত্যু বাড়ি আছে শুধুই কান্না।৫ দিন আগে বিয়ে হয়েছে মেয়ে পিংকির। বিয়ে বাড়িতে ছিল হৈ হুল্লুড়। এখন বিয়ে বাড়িতে আর হাসি নেই, কেবলই কান্নার রোল। নিহত হয়েছেন একই পরিাবরের ৫ জন। পরিবারের সদস্যদের হারিয়ে এখন শোকে স্তব্ধ। পিংকি তার ভাই ও চাচা মনা রায় পুরো মৌলভীবাজার পৌর শহর এখন হয়ে উঠেছে শোকাচ্ছন্ন। এম সাইফুর রহমান সড়কের পিংকি সু স্টোর নামক জুতার দোকানে দ্বি-তলা ভবনের বাসায় আকস্মিক ভাবে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই বিভীষিকাময় আগুন কেড়ে নিলো সকল উচ্ছ্বাস,আর আনন্দ উল্লাস উপহার দিলো ৫টি দগ্ধ মৃতদেহ। আগুন লাগা বাসার নিচে ছিলো দোকান ও ওপরে পরিবার নিয়ে থাকতেন সুভাষ রায়। গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় সুভাষ রায়ের মেয়ে পিংকির বিয়ে। গত সোমবার ছিলো বৌভাত অনুষ্ঠান। বিয়ে উপলক্ষে স্বজনরা তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। ভাগ্নীর বিয়েতে যোগ দেয়ার জন্য হবিগঞ্জ থেকে স্বপরিবারে মৌলভীবাজারে এসেছিলেন দিপা রায় (৩৫)। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে পরিবারের সাথেই হবিগঞ্জের উমেদ নগরে ফিরে যাওয়ার কথা ছিলো আজকালের মধ্যেই। কিন্তু দুই বছর আট মাসের মেয়েকে নিয়ে আর বাড়ি ফিরা হলো না। প্রাণ গেল মা-মেয়ের। এটা হয়তো কখনো কল্পনাই করেন নি, স্বামী সজল রায় এবং তার ছেলে।
সকাল সোয়া ১০টার দিকে পিংকি সু ষ্টোরে গ্যাস লাইনের রাইজার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্চে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে সকাল ১০টা ৩০মিনিটের সময় ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। পরে শ্রীমঙ্গলের আরও একটি ইউনিট সেখানে যোগ দেয়। দীর্ঘ দুই ঘন্টা তিনটি ইউনিট উদ্ধার অভিযান চালায়। আটকা পড়াদের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। তারা একই পরিবারের। এর মধ্যে একজন শিশুও রয়েছে। দুপুর ১২ টার দিকে আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনে।
নিহতরা হলেন- দোকানের মালিক সুভাষ রায় (৬৫), তার মেয়ে পিয়া রায় (১৪), তার ভাই মৃত প্রণয় রায়ের স্ত্রী দীপ্তি রায় (৪৫), শ্যালক সজল রায়ের স্ত্রী দীপা রায় (৩৫) ও দুই বছর আট মাসের শিশু বৈশাখী রায়।
আহত সুভাষ রায়ের ভাই মনা রায় (৪৫) একটি প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।সুভাষ রায়ের স্ত্রী জয়ন্তি রায় বলেন, “আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, সকালে চা জ্বাল দেয়ার জন্য গুম থেকে উঠি। উঠেই দেখি আমার বাসায় থাকা এক আত্মীয় আগুন বলে চিৎকার করছেন। পরে আমি চিৎকার করে সবাইকে সজাগ করি। বাসায় আমরা নয় জন ছিলাম। আমি ও পিংকির চাচা মনা রায়, দীপার ছেলে ও দোকানের কর্মচারী বাসার পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসি। বাকিরা সবাই বাসায় আটকা পড়েন”।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. আমির জানান, আমি আমার দোকানে বসা ছিলাম হটাৎ শুনি আগুন লেগেছে। আমি দৌড়ে দোকান থেকে নেমে পড়ি তখন দেখি আমার পাশের দোকান পিংকি সু স্টোরে ধাউ ধাউ করে আগুন জলছে ততক্কনে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমাদের করার আর কিছুই ছিলনা। আমরা অনেক বড় ধরণের দূর্ঘটনা থেকে বাঁচতে পেরেছি। এই দোকানে আতশবাজির ফটকা ছিল। যখন আগুন লাগে তখনই ফটকাগুলো ফুটতে শুরু করে। পরে বিকট শব্দে পরিস্থিতি ভায়াবহ রুপ নেয়।
প্রতিবেশী ভানু রায় বলেন, বিয়ে উপলক্ষে পিংকির মামা, মামী ও ভাই বোনরা এসেছিল। এর মধ্যে মামী দীপা ও মেয়ে বৈশাখী মারা গেছেন। বর্তমানে পিংকি মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন। পরিাবরের সবাইকে হারিয়ে সে স্তব্ধ।
তিনি জানান, বাসাটি তাদের পূর্ব পুরুষদের, পাক আমলের কাঠের তৈরী। দোতলায় কাঠের সিড়ি পুরো দুতলাই ছিল কাঠের তৈরী। ছাদ ছিল টিনের। দোকানে প্রবেশ মুখের বাম দিকে বাসার ভিতরে গ্যাসের রাইজার ছিল। ডান দিকে ছিল ইলেকট্রিক মিটার। সামনে ছিল তারের জঞ্জাল। এই কারণে আগুন ভয়াবহ রুপ নিয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী শেখ রুমেল আহমেদ বলেন, “পিডিবি ও জালালাবাদ গ্যাস এঘটনায় চরম অবহেলা করেছে। আগুন লাগার দুই ঘন্টা পরও বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়নি। এমনকি পৌর মেয়র, ব্যবসায়ীরা বারবার অভিযোগ করার পরও কোন সাড়া দেয়নি”।
সিনিয়র সাংবাদিক সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, “এই পরিবারের দুজন স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লেখা চিঠি দিয়ে তাদেরকে দুই হাজার টাকা দিয়েছিলেন। এখন একটি মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় আবারো এই পরিবারের ৫জন মারা গেল”।
ফায়ার সার্ভিস মৌলভীবাজারের উপ-পরিচালক আব্দুল্লাহ হারুন পাশা বলেন, আমরা ঘটনার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তদন্ত করে জানাবো। প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি দোকানের ভিতরেই ছিল গ্যাস লাইনের রাইজার। এখান থেকেই আগুনের উৎপত্তি হয়েছে”।
এঘটনায় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা। মঙ্গলবার বিকেলে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই তদন্ত কমিটির ঘোষণা করা হয়। আগামী ৭ কর্মদিবসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও প্রতিকারের সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন জানান, “অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া সুলতানা এর নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, জেলা প্রশাসকের তদন্ত কমিটির অন্যান্যরা হলেন। পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জিয়াউর রহমান, পিডিবির প্রতিনিধি, পল্লীবিদুৎ সমিতির প্রতিনিধি, পৌরসভার প্রতিনিধি কাউন্সিলার মনবির রায় মনজু, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ড্রাষ্ট্রিজ এর প্রতিনিধি, বিজনেস ফোরামের প্রতিনিধি। এই কমিটি চাইলে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডার প্রতিনিধি সংযোজন করতে পারবেন”।
তিনি বলেন, নিহতদের পরিবারে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। কারণ উদঘাটন করে এই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পরবর্তীতে এই ধরণের ঘটনা যাতে না ঘটে, সে গুলো ব্যবস্থা নেয়া হবে। মৌলভীবাজার পৌরসভাও অপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে”।
এঘটনায় পুলিশের সিলেট রেঞ্জর ডিআইজি কামরুল আহসান, জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন, পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ, পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান, চেম্বার সভাপতি মো. কামাল হোসেন, বিজনেস ফোরামের সভাপতি নুরুল ইসলাম কামরানসহ প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা।
পুলিশ সুপার ফারুক আহমদ বলেন, আমরা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বালি দিয়ে গ্যাসকে নিয়ন্ত্রণে এনেছি। দু:খের বিষয় একই পরিবারের ৫জন নিহত হয়েছেন। শহর বড় ধরনের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছে। নিহতদের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের পর সন্ধ্যায় দাহ করা হয়েছে”