আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে “ধর্মব্যবসা” সরকারের কাছে বন্ধ এবং শাস্তির দাবি
মোঃ কামরুজ্জামান সোমবার বিকেল ০৪:১৪, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০
ধর্মকে ব্যক্তিস্বার্থ/সমষ্টিগত ব্যবহার করাই ধর্মব্যবসা আর মানবতার কল্যাণে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ব্যবহার করাই ধর্মের সদ্ব্যবহার। সবচেয়ে বড় অধর্ম হচ্ছে সেটাই যা ধর্মের নামে করা হয়। নিন্মলিখিত কোরআনের আয়াতে এবং হাদিসে, কোরআনের আয়াত বিনিময়, স্বল্প মূল্যে বিক্রি এবং পারিশ্রমিক নিতে নিষেধ করা হয়েছে। নিজ হাতে উপার্জন করতে বলা হয়েছে।
১। “আমি যা অবতীর্ণ করেছি (কোরআন) তাতে তোমরা বিশ্বাস স্থাপন কর, তোমাদের কাছে যা আছে (তওরাত) এটি তারই সমর্থক। আর তোমরাই এর প্রথম প্রত্যাখ্যানকারী হয়ো না এবং আমার আয়াতকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করো না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করবে।” (সূরা বাকারাহ:৪১)
২। “তারা সেই লোক যাদেরকে আল্লাহতায়ালা পথ প্রদর্শন করেছেন। অতএব, আপনি তাদের পথ অনুসরণ করুন। আপনি বলে দিন, আমি তোমাদের কাছে এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এটা তো সারা বিশ্বের জন্য উপদেশবাণী”। (সূরা আনআম: ৯০)
৩। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কোরআন পড়ো এবং তার ওপর আমল করো। আর তাতে সীমালংঘন করো না, তার ব্যাপারে শৈথিল্য করো না, তার বিনিময় খেয়ো না এবং তাকে নিয়ে রিয়া করো না। ’ (মুসনাদে আহমাদ: ১৫৫৬৮, সুনানে বায়হাকি: ২৬২৪, মুজামে তাবরানি আওসাত: ২৫৭৪)
৪। হাদিসে বর্ণিত আছে, “রাসুল (সা.) এর সাহাবিরা নিজেদের কাজ-কর্ম নিজেরা করতেন। ফলে তাদের শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে যেত। এ জন্য তাদের বলা হয়, ‘যদি তোমরা গোসল করে নাও (তবে ভালো হয়)”। (বোখারি, হাদিস নং : ২০৭১)
৫। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিজ হাতের শ্রমে উপার্জিত জীবিকার চেয়ে উত্তম আহার কেউ কখনও গ্রহণ করেনি। আল্লাহর নবী দাউদ (আ.) নিজ হাতে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন”।(বোখারি, হাদিস নং : ২০৭২)
৬। পৃথিবীতে কোন ব্যবসা সবচেয়ে বেশী আরামের? – যাতে পরিশ্রম নেই।
৭। পৃথিবীতে কোন ব্যবসা সবচেয়ে বেশী নিরাপদ? – যাতে পুঁজি নেই।
৮। পুঁজিও নাই, পরিশ্রমও নাই এমন কোন ব্যবসা আছে পৃথিবীতে? সৎ ব্যবসা করে পেটের ভাত যোগানো মুশকিল, তাই আল্লাহ সৎ ব্যবসায়ীকে কিয়ামাতের দিন আপন আরশের ছায়াতলে স্থান দেবেন। কিন্তু অসৎ ব্যবসা? হেরোইনের ব্যবসাতে লাভ অনেক কিন্তু পরিশ্রম আছে, আবার ধরা পড়লে পুঁজি সব যাবেতো যাবেই, জেল থানাতেই থাকা লাগবে।
৯। একমাএ “ধর্ম ব্যবসা”- যাতে পরিশ্রম নেই। পুঁজি নেই।
১০। ধর্মব্যবসা বহুরূপী। ধর্মব্যবসায়ীরা বিভিন্ন কেতাবের ভাষা শিখে ও বেশভূষা ধারণ করে নিজেদেরকে একটি ধর্মীয় ভাবমূর্তি প্রদান করেন যেন মানুষ তাদেরকে ধর্মের কর্তৃপক্ষ বলে বিশ্বাস করে। এভাবে মানুষের ঈমানকে তারা আগে ছিনতাই করে, তারপর নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য নানাপ্রকার বক্রপথ তারা অবলম্বন করে। আমরা যদি উদাহরণ টানি তাহলে বহুরকম ধর্মব্যবসারই উদাহরণ আমাদের সমাজে বিরাজ করছে। পৃথিবীতে বিরাজিত তাবৎ ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যেই ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী রয়েছে।
কিন্তু আমাদের আলোচনার মূল ক্ষেত্র যেহেতু ইসলাম ধর্ম, তাই মুসলমান দাবিদার জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মব্যবসা যে সকল রূপ নিয়ে হাজির হয়েছে সেগুলোর উদাহরণ দিচ্ছি। (১) ওয়াজের মাধ্যমে অর্থ নেয়া। (২) মসজিদে নামাজ পড়িয়ে টাকা নেওয়া। (৩) জানাজা পড়িয়ে বা তার পরবর্তীতে কবর জেয়ারত করে, কুলখানি, চেহলামে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ও বিশেষ মোনাজাত করে টাকা নেওয়া। (৪) চুক্তি করে বা চুক্তি ছাড়াই কোর’আনের মাহফিল করে টাকা নেওয়া। (৫) রমজান মাসে খতম তারাবি বা অন্য যে কোনো উসিলায় কোর’আন খতম দিয়ে টাকা নেওয়া। (৬) মসজিদ মাদ্রাসার নির্মাণ বা উন্নয়নের নাম করে টাকা তুলে সেটা ঐ খাতে ব্যয় না করে নানা অসিলায় নিজেদের জন্য বৈধ করে নেওয়া। (৭) টাকার বিনিময়ে মিলাদ পড়ানো। (৮) প্রতারণামূলক রাজনীতি করে সেখানে ধর্মকে ঢাল হিসাবে এবং ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়িরূপে ব্যবহার করা। (৯) প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো বুনিয়াদি পরিবর্তন না এনে, ইসলামের কোনো নীতি প্রবর্তন না করে, রাষ্ট্রে ইসলামের কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠা না করে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম আখ্যা দেওয়া। (১০)সুদের নাম পাল্টে মুনাফা, ইন্টারেস্ট বা অন্য যে কোনো শব্দ ব্যবহার করে ধর্মীয় আবরণে সুদী কারবার করা। (১১)আখেরাতে মুক্তির উসিলা সেজে পীর-মুরিদী করে রোজগার করা। (১২) মাজার স্হাপন করে, অর্থের যোগান নিশ্চিত করা। ১১।বিভিন্ন সময়, নবী/রসূল/পয়গম্বর হিসেবে যাঁরা যুগে যুগে এ পৃথিবীতে এসেছেন, উনারা কি ধর্মীয় বাণী দিয়ে, দোয়া করে, ধর্ম প্রচার করে আয় রোজগার করতেন, নাকি উনারা অন্য কোন কাজের মাধ্যমে আয় করতেন? সবাই অন্য কোন কাজের মাধ্যমে, জীবিকা নির্বাহ করেন। একজন নবীও/খলীফা/ সাহাবি / তাবেয়ী / তাবে-তাবেয়ী ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে, কোন বিনিময় বা পারিশ্রমিক নেন নাই। ১২। আদম (আ.) ছিলেন একজন কৃষক। শিস (আ.)ও কৃষক ছিলেন। ইদরিস (আ.)-এর পেশা ছিল কাপড় সেলাই করা। কাপড় সেলাই করে যে অর্থ উপার্জন করতেন, তা দিয়ে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। নুহ (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। হুদ (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তাঁর পেশা ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। সালেহ (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন। লুত (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। ইবরাহিম (আ.)-এর জীবনী পাঠান্তে জানা যায় যে তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কখনো ব্যবসা, আবার কখনো পশু পালন করতেন। ১৩। ইসমাইল (আ.) পশু শিকার করতেন। ইয়াকুব (আ.)-এর পেশা ছিল ব্যবসা, কৃষিকাজ করা ও পশু পালন।ইউসুফ (আ.) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বেতন হিসেবে রাষ্ট্রীয় অর্থ গ্রহণ করতেন। ১৪। শোয়াইব (আ.)-এর পেশা ছিল পশু পালন ও দুধ বিক্রি। দাউদ (আ.) ছিলেন রাজা ও নবী। নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন। সোলায়মান (আ.) ছিলেন সমগ্র পৃথিবীর শাসক ও নবী। তিনি তাঁর পিতা থেকে অঢেল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন।মুসা (আ.) পশু পালন করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন ইলিয়াস (আ.)-এর পেশাও ছিল ব্যবসা ও পশু পালন।আইউব (আ.)-এর পেশা ছিল গবাদি পশু পালন।ইউনুস (আ.)-এর গোত্রের পেশা ছিল চাষাবাদ। সুতরাং কারো কারো মতে, তাঁর পেশাও ছিল চাষাবাদ।জাকারিয়া (আ.) ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। ১৫। ঈসা (আ.) এক ব্যক্তিকে অসময়ে ইবাদাতখানায় দেখে প্রশ্ন করলেন, তুমি এখানে বসে ইবাদত করছ, তোমার রিজিকের ব্যবস্থা কে করে? লোকটি বলল, আমার ভাই আমার রিজিকের ব্যবস্থা করে। ঈসা (আ.) তাকে বলেন, সে তোমার চেয়ে অনেক উত্তম। (হেদায়াতুল মুরশিদিন)। ১৬। মহানবী (সা.) ছিলেন একজন সফল ও সৎ ব্যবসায়ী। সব নবী-রাসুল ছাগল চরাতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো নবী নেই, যিনি ছাগল চরাননি।’ জনৈক সাহাবি প্রশ্ন করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? প্রত্যুত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ, আমিও মক্কায় অর্থের বিনিময়ে ছাগল চরিয়েছি।’ বলা বাহুল্য যে মহানবী (সা.)-এর সাহাবিরা অনেকেই ব্যবসা করতেন। বিশেষ করে মুহাজিররা ছিলেন ব্যবসায়ী আর আনসাররা ছিলেন কৃষক। ১৭। কোরআন/ হাদীসের আদেশ সরাসরি অমান্য করে, প্রচলিত “ধর্ম ব্যবসা” বন্ধ এবং শাস্তির দাবি করছি, সরকারের কাছে। ১৮। আমরা যদি সত্যিই ইসলামকে ভালোবাসি, আল্লাহর সন্তুষ্টি আশা করি, আমাদের আমলকে কবুলযোগ্য করতে চাই তাহলে এই সুস্পষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে সোচ্চার হতেই হবে।
লেখক:- মেজর মোহাম্মদ আলী(অব.), চেয়ারম্যান, দাউদকান্দি উপজেলা পরিষদ