ঢাকা (রাত ১১:৪২) রবিবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

আইন-৩১’র চড়ুইভাতি



চড়ুইভাতি’ নামটির সাথে আমাদের অনেকেরই কমবেশি পরিচয় আছে।কিছু মানুষের কাছে এই শব্দটি অপরিচিত হওয়াটাও অস্বাভাবিক না। বন বাদাড়ে চড়ুই পাখিদের কিচিরমিচির ডাকের ছন্দে সংগৃহীত খাবার একসঙ্গে খাওয়া থেকে হয়তো চড়ুইভাতি শব্দের উৎপত্তি। শিশুদের সংগ্রহ করা চাল ডালে রাঁধা খাবার খাওয়াই হচ্ছে চড়ুইভাতি।

কিন্তু এখনকার সময়ে এসে সেটা শিশুদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নাই। এটা ছড়িয়ে পড়েছে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা একত্রে মিলে চড়ুইভাতি করে থাকে। এরই ধারাবাহিতায় ইবির আইন-৩১’র ব্যাচেরও চড়ুইভাতি হয়ে থাকে।

কিন্তু একের পর এক তারিখ পরিবর্তন হতে লাগল। সব বাধা টপকিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি ব্যাচের চড়ুইভাতির তারিখ নির্ধারন করা হয়। এরপর মেরিন, জাহিদ, শামীম, সাজুরা মিলে ক্যাম্পাসের অদূরে শ্রীরামপুরের একটু মনোমুগ্ধকর স্থান পরিদর্শন করে আসে এবং স্থানীয় মাতাব্বরের সাথে কথা বলে আসে।

যেই কথা সেই কাজ; ব্যাচের ১০ জনকে দেয়া হলো টাকা উঠানোর দায়িত্ব। তারা নিষ্ঠার সাথে টাকা উঠীয়ে চড়ুইভাতির আগের দিন কয়েকজন মিলে বাজার করে আনলো। খাবার তালিকায় ছিল সোনালী মুরগি, ডিম ,ডাল আর দই।

২৭ তারিখ সাতসকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে চোখ কচলে ঘুম থেকে উঠার পরে প্রথমে চোখে পড়ল বন্ধু মেজবাহ’র দাঁতকনকনানি দিয়ে গোসল দিয়ে আসার চিত্র। প্রথম ভয় পেয়েছিলাম পরে আমি নিজেও মাঘের শীতকে সামনে ঠেলে ঠান্ডা পানিতে নিজের গা ভিজিয়ে নিলাম। হল থেকে মেজবাহ আর আমি বের হয়ে দেখি বন্ধুরা একেকজন একেকটা হান্ডি পাতিলের মালিক হয়ে গেছে। কারো হাতে দা, কারো হাতে সসপেন, আবার কেউবা বালতি হাতে করে শ্রীরামপুরের দিকে হাটছে। আমরা দুজনের যেতে খানিকটা দেরি হলেও বাকিরা ঠিক ৯ টায় শ্রীরামপুর পৌছে গেছে।

আমরা দুজন যেতে চুলাতে আগুন দেয়া হয়ে গেছে। একপাশে আফসানা, তামান্না, রিচিরা পেয়াজ, রসুন, আদা বাটায় ব্যস্ত সময় পার করছে অন্যদিকে মালিহা দৃষ্টির সুন্দর সুন্দর মূহুর্তগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত। আমার সবার প্রিয় সুমন গাজী, সাকিন,মুয়াজ,সাহারুলরাতো সাউন্ড বক্সের পাশ ছাড়তেই নারাজ। তারা একের পর এক আধুনিক গানের বারটা বাজানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করেছে। একটু পরেই গিটার কাঁধে উপস্থিত উদয়, যার গান ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই জমে না।ওদিকে উনুনের আগুন পাতিলের গা গরম করে দিয়েছে।

আমাদের আলাদা কোনো বাবুর্চি ছিলনা। চপলের রান্নার হাত বরাবরই ভালো, তার সাথে সহযোগিতায় ছিল নাহিদ,রতন আর সোহাগ। চপলের লবণ চাওয়ার সময় সবার চোখ থাকতো তার দিকে কারণ সে স্বাদ পরীক্ষা করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই মাংশের টুকরা ও ডাল সাবার করত। অন্যদিন খাবারের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী না হলেও চড়ুইভাতির দিন ক্ষুধায় সবার পেট চোঁ চোঁ করত।

যাইহোক বেলা ২ টায় রান্না শেষ হওয়ার ঠিক আগ মূহুর্তে আমরা সবাই মিলে শ্রীরামপুরের সৌন্দর্যময় চারিদিক অবলোকন করি।

এবার রান্না শেষ হলো ,সবাই যার যার মতো করে দায়িত্ব নিয়ে খাবার পরিবেশন করতে শুরু করে। বিলের মাঝখানে মাদুরের পাটিতে বসে খাবার খাওয়ার একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করে। যথারীতি ডিম-সাদাভাত দিয়ে খাবার দেয়া শুরু করি। আমরা ৯ জন ছিল পরিবেশনের দায়িত্বে। একজন ডাল ,অন্যজন মুরগির রোস্ট,আরেকজন পানি দিতে পুরো সময়ই ব্যস্ত ছিল। খাবার তালিকায় সালাদ ছিল অন্যতম মুখরোচক আইটেম যেটা আমার নিজের হাতে তৈরি ছিল। শেষ পর্বে দই ছিল খাবারের তৃপ্তি।

খাবার শেষে সবার গ্রুপ ফটো তুলে দিনের দ্বিতীয় আয়োজন খেলাধুলায় অংশগ্রহন করি।

মেয়েদের বালিশ আর সুঁইসুতা খেলা অন্যদিকে ছেলেদের হাঁড়িভাঙ্গা,বেলুন ফোটানো খেলা। সবগুলো খেলাতে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীদের সাধ্যমতো পুরস্কৃত করা হয়।

দীর্ঘ ছুটির পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেই পরীক্ষা দিতে ব্যস্ত ছিলাম। আজকের এই চড়ুইভাতি আমাদের ক্লান্তি দূর করে নতুন উদ্যোমে কাজ করার সাহস জুগিয়েছে।

চড়ুইভাতি মতো সুন্দর আয়োজন করার জন্য ফ্রন্টলাইনার ছিলো বন্ধু মেরিন, জাহিদ, সাজু, জুবায়ের,  শিহাব। তাদের সাহসী উদ্যোগ আমাদের প্রাণবন্ত করেছে।সারাদিনের আনন্দ শেষে নিজ গন্তব্য পৌছে যাই সন্ধ্যার আগেই।

আমরা যেখানে রান্নাবান্না এবং খাবার খাওয়ার সময় যে ময়লা জমেছিল সেগুলো একটি বস্তা করে নিয়ে আসি এবং ডাস্টবিনে ফেলে দেই।

চড়ুইভাতির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কত খুনসুটি, রাগ, বায়না, আবদার!

আমাদের জীবনে স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলোর মধ্যে আজকের এই চড়ুইভাতির আয়োজনও স্মৃতিমধুর হয়ে থাকবে। আমাদের বন্ধন টিকে থাকবে অনন্তকাল।

ধীরে ধীরে চড়ুইভাতি, বনভোজন বা পিকনিকের তকমা নিয়ে করপোরেট কালচারে রূপ নিয়েছে। বর্তমানে বনভোজন দুই তিনদিনও স্থায়ী হয়। মাঝেমধ্যে বনভোজনকে আধুনিকীকরণের সুরে আউটিং বা শিক্ষাসফর বলেও চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব আউটিং বা শিক্ষাসফর সাধারণত কোনো ট্যুর কোম্পানিকে দিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।

আমাদের গ্রামীণ পরিবেশের সেই ছোট্টবেলার চড়ুইভাতি আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় চড়ুইভাতি হারিয়ে যাচ্ছে বনভোজন পিকনিক আর শিক্ষা সফরের ভীড়ে। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে চড়ুইভাতির আসল নামকরণ ও বিশেষত্বটা তুলে ধরা উচিত। এতে করে বাঙালির ঐতিহ্য ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকবে হাজার বছর ধরে।


লেখক:-কামাল হোসেন

আইন বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়,কুষ্টিয়া-৭০০৩

শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT