শিক্ষার্থীদের বোরকা-হিজাবে আপত্তি : প্রধান শিক্ষিকার উদ্ভট ভাবনা
এস এম সাখাওয়াত বৃহস্পতিবার রাত ০৯:৫২, ৩০ জানুয়ারী, ২০২৫
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কালেক্টরেট গ্রীণভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক নির্যাতন ও শিক্ষার্থীদের শালীন পোষাকের বিরোধীতা করা সহ নানা অভিযোগ উঠেছে বিদ্যালয়ের স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকারী প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদের বিরুদ্ধে। আর এ নিয়ে স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদকে স্ব-পদে পুনর্বহাল না করতে ২০২৪ সালের ৭ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়ের ৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে ২৭ জন শিক্ষকের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিখিত অভিযোগ পত্র দেয়া হয়েছে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর। পাশাপাশি অভিযোগ দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসককেও। এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করেছেন ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি। তবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সমূহ সঠিক ও সত্য নয় বলে দাবী করেছেন রোকসানা আহমেদ।
লিখিত অভিযোগে শিক্ষকরা বলেন, শ্রেণীকক্ষের চারিদিকে ফ্যান থাকলেও শিক্ষকের মাথার ওপর থেকে খুলে রাখা হয় বৈদ্যুতিক ফ্যান। পাশাপাশি শিক্ষক যেন বসে ক্লাস নিতে না পারেন, তাই উঠিয়ে নেয়া হয় শিক্ষকের চেয়ার। পাঠদানে আরামদায়ক না করে শিক্ষকদের ক্লাসকে আরো তথাকথিত কার্যকরী করার নামে করা হয় এমন বর্বও আচরণ। এছাড়া বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা কেউ হিজাব আবার কেউ বোরকা পরিধান করে এলে তা পরিধানে তিনি আপত্তি জানান। এমনকি বিদ্যালয় ছাড়ারো হুমকি দিতেন তিনি। আর অর্থ কেলেঙ্কারী ছিল তার নিত্য দিনের স্বভাবের অংশ। মূলত আওয়ামীলীগের প্রভাব খাটানো সেই প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদের নিয়োগই ছিল অবৈধ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষকরা বলেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ দায়িত্ব পালনকালে দূর্ব্যবহার ও অসদাচরণের মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রতিনিয়ত মানসিক নির্যাতনের মধ্যে রাখতেন। তার দূর্ব্যবহার ছিল মাত্রাতিরিক্ত ও বর্ণনাতীত। শিক্ষক স্বল্পতার জন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিদিন ৬টা বা ৭টা ক্লাসের সব কয়টাতে পাঠদান করতে হতো। এটাতে কোন সমস্যা না থাকলেও সমস্যা হচ্ছে সকাল পৌণে ৮টা থেকে দুপুর সোয়া ২টা পর্যন্ত একটানা দাঁড়িয়ে ক্লাস নিতে বাধ্য করা। কারণ এমনকি শ্রেণিকক্ষ থেকে শিক্ষকের বসার চেয়ার সরিয়ে নেয়া হয়েছিল, যা শিক্ষকদের জন্য ছিল অবর্ণনীয় কষ্টকর। আর প্রচন্ড গরমে শিক্ষকের মাথার ওপরে থাকা ফ্যানগুলো খুলে নিয়েছিলেন, যা ছিল চরম অমানবিকতা।
অভিযোগকারী শিক্ষকরা বলেন, তার অনিয়ম-দূর্নীতি ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারতো না। কারণ সবসময়ই তিনি প্রশাসন ও চাকুরিচ্যুত করার ভয় দেখাতেন। যা শিক্ষকদের প্রতি মূহুর্তে আতংকের মধ্যে রাখতো। শিক্ষকদের সাথে দূর্ব্যবহার করার কারণে সাবেক জেলা প্রশাসক সরদার সরাফাত আলী একটি সভায় তাকে চরমভাবে ভৎর্সনা করেন। ফলে তিনি সভা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। তাছাড়া খন্ডকালীন শিক্ষকরাও ছিলেন বৈষম্যের শিকার। তাদের বেতন না দিয়ে বৈষম্য করে রেখেছিলেন রোকসানা আহমদ। অর্থ সংকটের অযুহাতে খন্ডকালীন শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি না করলেও তার অব্যহতি নেয়ার পর অর্থ কমিটি হিসাব করে দেখতে পায়, খন্ডকালীন শিক্ষকবৃন্দকে নিয়মিতকরণের আর্থিক সঙ্গতি রয়েছে স্কুলের।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বোরকা পরার বিষয়ে রোকসানা আহমেদের তীব্র আপত্তি ছিল। আর তাই বোরকা পরার জন্য তিনি মেয়ে শিক্ষার্থীদেও সকলের সামনে ভৎর্সনা করে মাদ্রাসায় ভর্তির পরামর্শ দিতেন। এমনকি বোরকার মতো মেয়ে শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার বিষয়েও চরম বিরক্তি প্রকাশ কওে ইসলামী চালচলনে নিরুৎসাহিত করতেন তিনি। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য নামাজের স্থানের বিষয়ে তিনি ছিলেন চরম উদাসীন যা নামাজ আদায়ের জন্য প্রতিবন্ধকতা ছিল।
অভিভাবকরা জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন রোকসানা আহমেদ। যেখানে গ্রীণভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের এ্যাপুলেট কিনতে ২০ টাকা লাগে সেখানে বিদ্যালয়ের ড্রেস কর্নার থেকে উচ্চমূল্যে শিক্ষার্থীদের স্কুল ইউনিফরম ও অ্যাপুলেট কিনতে বাধ্য করতেন ম্যাডাম রোকসানা। ২০ টাকার অ্যাপুলেট ১০০ টাকায় কিনতে বাধ্য করা হলেও রোকসানা আহমেদ অবসর নেয়ার পর সেই ১০০ টাকা করে বিক্রি করা অ্যাপুলেট আবারো ২০ টাকায় বিক্রি চলছে ড্রেস কর্নারে। পাশাপাশি প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষার পরে স্কুলে কোচিং করতে বাধ্য করতেন তিনি।
অভিভাবকরা বলছেন, যেখানে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাইব্রেরী, ল্যাবরেটরী ও আইসিটি ল্যাব আছে, সেখানে কালেক্টরেট চত্বরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত কালেক্টরেট গ্রীনভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে এসবের কোনো বালাই ছিলনা। বরং শিক্ষার্থীদের জন্য এসব না করে তিনি নিজের পকেট গোছানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন।
লিখিত অভিযোগ সূত্রে আরো জানা যায়, স্বেচ্ছায় অব্যহতি গ্রহণ করা প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমদ গ্রীনভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ে কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষক হিসেবে ২০০১ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত হলেও ২০১৫ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিয়োগের বিধি অনুসারে হয় নাই। কেননা ২০০৩ সালে নিম্ন মাধ্যমিক শাখায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ তার চাইতে বেশি বেতনে যোগদান করেন। পরবর্তীতে প্রাথমিক শাখায় কর্মরত শিক্ষকবৃন্দের বেতন বৃদ্ধি হলেও রোকসানা আহমদের বেতন মাধ্যমিক শাখায় কর্মরত শিক্ষকের বেতনের চাইতেও কম থাকে। তাই প্রশ্ন ওঠে তিনি মাধ্যমিক শাখায় নিয়োগ প্রাপ্ত হলে বেতনের এমন বৈষম্য থাকার কথা নয়। যা তার প্রধান শিক্ষকের পদে থাকার অযোগ্যতা প্রমাণ করে। আর তাই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখার দুই জন সিনিয়র শিক্ষক রোকসানা আহমদকে মাধ্যমিক শাখায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের যৌক্তিকতা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করেন। কিন্তু মামলাটি চলমান থাকা অবস্থায় বাদীরা চাকুরী হতে অবসরে যান। বাদীদের একজন মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে বাদীদেরকে মামলা পরিচালনার পুরো অর্থ পরিশোধ সাপেক্ষে মামলাটি আপোষ মিমাংসা করে মামলাটি প্রত্যাহার করিয়ে নেন। এমনকি মামলা পরিচালনার সকল অর্থ স্কুলের তহবিল থেকে ব্যয় করা হয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করেন শিক্ষকবৃন্দ।
বর্তমান শিক্ষকদের অভিযোগ, মামলা চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয় প্রায় এক মাস প্রধান শিক্ষক বিহীন অবস্থায় ছিল। ওই সময় তৎকালীন জেলা প্রশাসক পরবর্তী সিনিয়র শিক্ষককে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব প্রদানের নির্দেশ দিলেও তা না করে স্কুল প্রধান শিক্ষক বিহীন রাখেন স্বেচ্ছায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ। সে সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বোর্ড রেজিষ্ট্রেশনে প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষরের স্থলে অফিস সহকারীর স্বাক্ষর প্রদাণের নির্দেশ দেন যা আইনের সম্পূর্ণ লংঘণ।
এ সকল বিষয়ে কালেক্টরেট গ্রীণভিউ উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, অভিযোগগুলো নিয়ে এই মুহুর্তে কথা বলা উচিত নয়। কারন তদন্ত কমিটি এসব অভিযোগের তদন্ত কাজ করছে। আশা করি, সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে গত ২১ আগষ্ট স্বেচ্ছায় অবসর নেয়া প্রধান শিক্ষক রোকসানা আহমেদ তার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সকল অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটিকে যথাযথ প্রমাণসহ আমার বক্তব্য প্রদাণ করেছি। শ্রেণীকক্ষে ফ্যান ও চেয়ার সরিয়ে নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বেশিরভাগ শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের মাথার ওপরে ফ্যান লাগানোর সুযোগ ছিল না। এখন হুক লাগিয়ে ফ্যান দেয়া হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই। ষড়যন্ত্র করে জোরপূর্বক স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করানো হয়েছিল বলেও দাবি করেন রোকসানা আহমেদ।
এ বিষযে তদন্ত কমিটির প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মতিন বলেন, তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে। আশা করি খুব দ্রুতই জেলা প্রশাসনকে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। সরেজমিনে তদন্তে যা পাওয়া গেছে প্রতিবেদনে তাই উল্লেখ থাকবে। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিবেন বলেও জানান তিনি।