লোহাগড়ায় আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনকে ঘিরে কালো টাকার ছড়াছড়ি!
মেঘনা নিউজ ডেস্ক শনিবার রাত ০৯:৫৩, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯
এসকে,এমডি ইকবাল হাসান, নড়াইল প্রতিনিধিঃ নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেনকে ঘিরে যেন কালো টাকার ছড়াছড়ির অভিযোগ উঠেছে ! সভাপতি পদে একটি কাউন্সিলর ভোটের দাম উঠেছে ৭ হাজার টাকা এবং সাধারণ সম্পাদক পদে কাউন্সিলর ভোটের দাম উঠেছে ৬ হাজার টাকা।
কাউন্সিলররা একটি ভোট একাধীক প্রার্থীর কাছেও বিক্রি করছেন। সবমিলিয়ে প্রার্থীরা এখন বেকায়দায়। দলীয় নেতা-কর্মী, সমর্থক ও প্রার্থীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ ত্রি- বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে এস,এম,এ হান্নান রুনু সভাপতি ও সৈয়দ ফয়জুল আমির লিটু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনের পরে পূর্নাঙ্গ কমিটিকে জেলা আওয়ামী লীগ অনুমোদন দেয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। সেই অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কমিটির মেয়াদ রয়েছে আরো ১৩ মাস।
অথচ রাত পোহালেই রবিবার(১৭ অক্টোবর) সম্মেলন হতে যাচ্ছে।
সর্বশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে নির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদক কে বাদ রেখেই গত ৩০ সেপ্টেম্বর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি গঠন করে জেলা আওয়ামী লীগ। বিগত উপজেলা নির্বাচনে দলের উপজেলা সভাপতি এস,এম,এ হান্নান রুনু এবং দলের সাধারণ সম্পাদক তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান সৈয়দ ফয়জুল আমীর লিটু স্বতন্ত্র (আ,লীগ বিদ্রোহী) প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দিতা করেন। এস,এম,এ হান্নান রুনু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
লোহাগড়ায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নির্বাচিত সভাপতি ও সম্পাদক এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে তাদের ছাড়া দলের কর্মকান্ড,অস্তিত্ব নেতা-কর্মীরা কল্পনাও করতেন না। যেকারনে সম্মেলনে শৃংখলা, তোড়জোড়,প্রাণ নেই বলে দাবি করছেন অনেক নেতা-কর্মী ও তাদের সমর্থকরা।
সম্মেলনকে ঘিরে মাইকিং,পোস্টারিং বা তেমন কোন প্রচারণা নেই। সম্মেলনে অতিথির তালিকা তৃণমূলের এমনকি উপজেলা কমিটির বেশিরভাগ নেতারাই জানেননা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক প্রার্থীসহ দলের নেতা-কর্মীরা জানায়, এবারের সম্মেলনে কালো টাকার ছড়াছড়ি হচ্ছে। তাই ক্যাসিনো সমর্থক নেতারাই নেতৃত্বে আসার সম্ভাবনা বেশি।
এখন টাকা দিয়ে ভোট কিনে যেসব প্রার্থী নেতা নির্বাচিত হচ্ছেন। নির্বাচিত সেই নেতা ভবিষ্যতে টাকার বিনিময়ে উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের ইউনিয়ন কমিটি বিক্রি করবেন। এমন আশংকাও করছেন দলের অনেকে।
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, সম্মেলন উপলক্ষে প্রস্তুতকৃত কাউন্সিলর তালিকা নিয়ে এখনো যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। নিয়ম থাকলেও ১২টি ইউনিয়নের প্রতিটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সম্পাদক কাউন্সিলর হিসাবে অর্ন্তভূক্ত হতে পারেননি। ইউনিয়নের সভাপতি বা সম্পাদকের পছন্দের তালিকায় না থাকলে পুরন হয়নি কাউন্সিলর হওয়ার স্বপ্ন। আবার সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির যে সব নেতা তালিকা যাচাই-বাছাই করেছেন তাদেরও পছন্দের হতে হয়েছে। নইলে তালিকায় নাম ওঠেনি।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী অভিযোগ করেন, জয়পুর ইউনিয়নে কেন্দ্রীয় বা জেলা কমিটির নির্দেশনা মানা হয়নি। তড়িঘড়ি করে শুক্রবার রাতে দিঘলিয়া ইউনিয়নের ৩১জন কাউন্সিলর চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন দলকে তৃণমূল থেকে গড়বার জন্যে।
অথচ এখানকার কয়েকজন নেতা টাকার বিনিময়ে কাউন্সিলর করেছে। যে সব নেতার নামে ভিজিএফ, টিআর,কাবিখার টাকা আত্মসাৎ সহ নানা অভিযোগ ছিল তারাও প্রার্থী হয়েছেন। ভোট কিনছেন উচ্চ দামে। ইউনিয়ন নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়ে পরাজিত হওয়া নেতাও বড়পদে প্রার্থী হয়েছেন। ভোট কিনছেন। চলছে কালোটাকার ছড়াছড়ি। ওই সব নেতারা নির্বাচিত হলে সমাজ,দেশ ও রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ফয়জুল আমীর লিটু অভিযোগ করেন,আমাদের কমিটির মেয়াদ এখনো ১৩ মাস আছে। বিশেষ কারনে কেন্দ্রীয় ও জেলার দু-একজন নেতা নিয়মভঙ্গ করে সম্মেলন করাচ্ছেন। আমাদের দল থেকেতো বহিঃস্কার করা হয়নি। কেন্দ্রীয় কমিটি শোকজ করেছে। জবাব দিয়েছি। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আমাদের ক্ষমাও করেছেন। অথচ বিশেষ উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে সম্মেলন করানো হচ্ছে। তিনি জানান, নিয়ম রয়েছে প্রতিটি ওয়ার্ডের সভাপতি ও সম্পাদক কাউন্সিলর হবে। অথচ বেছে বেছে কাউন্সিলর করা হয়েছে। নলদী ইউনিয়নের কালিনগর ওয়ার্ডের সম্পাদক সুব্রত,কাশিপুর ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ডের সম্পাদক রিয়াজুল কে বাদ দেয়া হয়েছে।
দিঘলিয়া ইউনিয়নে জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার ক্যারিশমায় ১নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক নুর আলীকে বাদ দেয়াসহ ওই নেতার পছন্দের কয়েকজনকে কাউন্সিলর করা হয়েছে। অধিকাংশ ইউনিয়নের ওয়ার্ডের সভাপতি ও সম্পাদক কর্তাদের পছন্দের লোক না হওয়ায় কাউন্সিলর বঞ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন কেন্দ্রীয় ও জেলার নেতা নিজেদের বিশেষ স্বার্থ হাসিলের জন্যে উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত কমিটির সভাপতি ও সম্পাদককে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে বা কাউন্সিলর হিসাবে রাখেননি। প্রধানমন্ত্রী দলে শুদ্ধি অভিযান চালাচ্ছেন। অথচ কেন্দ্রীয় ও জেলার কয়েকজন নেতা অশুদ্ধি অভিযানে নেমেছেন। কাউন্সিলর বঞ্চিত দিঘলিয়া ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক নুর আলী অভিযোগ করেন, নিয়ম বহিঃভূতভাবে আমাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভাপতি উপজেলা চেয়ারম্যান এস,এম,এ হান্নান রুনু বলেন, আমাদেরকে সম্মেলনে ডাকা হয়নি।সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি বা কাউন্সিলরও রাখা হয়নি। বিশেষ উদ্দেশ্যে এ সম্মেলন করা হচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দলের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাধারণ ক্ষমা করেছেন। কিন্তু কেন্দ্রের ও জেলার নেতারা আমাদের ক্ষমা করেননি। তিনি আরো বলেন, উপজেলা নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটি আমাকে শোকজ করেছিল। শোকজের জবাব দেবার পরে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এমপি আমার অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে ২১ অক্টোবর নিজ স্বাক্ষরিত চিঠি দিয়েছেন। অথচ সম্মেলন হচ্ছে আমাকে বাদ দিয়ে।
সম্মেলনে সভাপতি পদে প্রার্থীরা হলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মঞ্জুরুল করিম মুন, লোহাগড়া পৌর মেয়র মোঃ আশরাফুল আলম, উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি মুন্সী আলা উদ্দিন, সহসভাপতি একেএম ফয়জুল হক রোম, একেএম কাইয়ুম চুন্নু, ওয়াহিদুজ্জামান বাচ্চু, সলিমুল্লাহ পাপ্পু। সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থীরা হলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোঃ মতিয়ার রহমান, সহসভাপতি লেঃ কমান্ডার এএম আব্দুল্লাহ(অবঃ), সিনিয়র যুগ্মসাধারণ সম্পাদক শেখ সিহানুক রহমান, জেলা পরিষদের সদস্য ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ সাজ্জাদ হেসেন মুন্না, সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ নজরুল সিকদার, সৈয়দ মসিয়ুর রহমান।
দলীয় সূত্র জনায়,লোহাগড়া সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে রবিবার সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি থাকছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ আব্দুর রহমান। বিশেষ অতিথি থাকছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন(এমপি), বিশেষ অতিথি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এস,এম কামাল হোসেন। উদ্বোধন করবেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডঃ সুবাস চন্দ্র বোস। প্রধান বক্তা থাকছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন খান নিলু। সভায় সভাপতিত্বে কে করবেন তা নিয়ে দোলাচলে রয়েছেন নেতারা।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডঃ সুবাস চন্দ্র বোস বলেন, কাউন্সিলর তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। রবিবারে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সবমিলিয়ে সম্মেলনকে ঘিরে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। অনেকেই এ সম্মেলনকে ”ভূয়া বাজির সম্মেলন” বলছেন।