ইসরা-মিরাজ : করণীয় ও বর্জনীয়
মেঘনা নিউজ ডেস্ক বৃহস্পতিবার সকাল ১১:০৫, ১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩
রাসূল সা:-এর মুজিজাগুলোর মধ্যে অন্যতম মুজিজা হলো ইসরা ও মিরাজ। ‘ইসরা’ অর্থ নৈশভ্রমণ। আর ‘মিরাজ’ অর্থ ঊর্ধ্বারোহণের যন্ত্র। মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ সা:-কে এক রাতে মক্কা থেকে ফিলিস্তিনের ‘মসজিদে আকসা’ (জেরুসালেম) পর্যন্ত, সেখান থেকে ঊর্ধ্বে সাত আসমান পার করিয়ে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যান। মক্কা থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত ভ্রমণকে ‘ইসরা’ এবং সেখান থেকে ঊর্ধ্বে গমনকে ‘মিরাজ’ বলে। মহান রবের ইরশাদ-‘পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে নৈশভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত।’ (সূরা ইসরা-১)
মিরাজের সংক্ষিপ্ত ঘটনা : এক রাতে রাসূল সা: হাতিমে কাবায়, অন্য বর্ণনায় উম্মেহানির গৃহে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাতের শেষ দিকে জিবরাইল আ: রাসূল সা:-এর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁর বক্ষ বিদারণ করে হৃৎপিণ্ড বের করেন, তা জমজমের পানি দিয়ে ধৌত করে- ঈমান ও হিকমাত দিয়ে পূর্ণ করে দেন এবং বোরাকের পিঠে আরোহণ করিয়ে বায়তুল্লাহ থেকে বায়তুল মাকদিসে নিয়ে যান। সেখানে পৌঁছে বোরাকটিকে একটি পাথরের সাথে বেঁধে বায়তুল মাকদিসে দু’রাকাত সালাত আদায় করেন। অতঃপর তাঁর কাছে ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের বিশেষ বাহন উপস্থিত করা হয়। মতান্তরে ওই বোরাকের মাধ্যমে জিবরাইল আ: তাঁকে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের জন্য ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যান।
পথিমধ্যে প্রথম আসমানে আদম আ:, দ্বিতীয় আসমানে ইয়াহইয়া ও ঈসা আ:, তৃতীয় আসমানে ইউসুফ আ:, চতুর্থ আসমানে ইদরিস আ:, পঞ্চম আসমানে হারুন আ:, ষষ্ঠ আসমানে মুসা আ: এবং সপ্তম আসমানে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম আ:-এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও পরিচয় হয়। অতঃপর জান্নাত-জাহান্নাম ও ‘বায়তুল মামুর’ পরিদর্শন করেন। সিদরাতুল মুনতাহা পৌঁছে জিবরাইল আ: তাঁকে একা ছেড়ে আসেন। এরপর রাসূল সা:-কে ‘রফরফ’ বাহন আরশ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। অতঃপর রাসূল সা:-কে এক টুকরা মেঘ আচ্ছাদিত করে ফেলে। তখন রাসূল সা: সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। (ইবনে আব্বাস রা:-এর বর্ণনা অনুযায়ী) এ সময় মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অতীব কাছে আসেন এবং তাঁর দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ সময় উভয়ের মধ্যে দূরত্ব ছিল দুই ধনুক বা দুই গজেরও কম। এ বিষয়ে মহান রবের ইরশাদ- ‘অতঃপর নিকটবর্তী হলো এবং ঝুঁকে গেল। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল বা তারও কম। তখন আল্লাহ স্বীয় বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন।’ (সূরা নাজম : ৮-১০) পুনরায় তাকে পূর্ব দিগন্ত আলোকিত হওয়ার আগেই মক্কায় পৌঁছে দেয়া হয়।
সংঘটিত হওয়ার সময় : মিরাজ সংঘটিত হওয়ার সঠিক তারিখ বা দিনক্ষণ সম্পর্কে মুহাদ্দিসিন ও ওলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য পরিলক্ষিত হয়, এ সম্পর্কে তাদের মধ্যে বেশ কিছু মতামত পাওয়া যায়। তা হলো- হিজরতের আট মাস আগে, এক বছর আগে, এক বছর দুই মাস আগে। হাফেজ ইবনে কাসির রহ: তাবেয়ি ইবনু শিহাব জুুহরির বরাতে বলেন, হিজরতের এক বছর আগে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। মাস নিয়েও যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, রজব, রমজান ইত্যাদি। অতএব নির্দিষ্টভাবে ২৭ রজব রাতে মিরাজ হয়েছিল বলে যে কথা- ভারত উপমহাদেশে প্রচলিত আছে তা নিতান্তই দলিলবিহীন। (সিরাতে মুস্তফা-১/৩২২)
মিরাজের প্রাপ্তি ও আশ্চর্য দর্শন : এ সফরে নবীজীকে তিনটি উপহার দেয়া হয়। ‘পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত এবং এই উম্মতের যারা শিরক থেকে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করবে, তাদের গুনাহগুলো মাফ করে দেয়ার ঘোষণা।’ (মুসলিম-১৭৩)
এ সফরে নবী সা: তামার নখবিশিষ্ট একদল লোককে দেখলেন, যারা স্বীয় নখ দিয়ে নিজেদেরই গাল ও বুকে আঁচড় কাটছে। জিজ্ঞাসা করলেন, জিবরাইল! এরা কারা? বললেন, এরা ওই সব লোক, যারা মানুষের গোশত খেত এবং তাদের সম্ভ্রমে আঘাত হানত। অর্থাৎ গিবত করত এবং মানুষকে লাঞ্ছিত করত। (আবু দাউদ-৪৮৭৮)
নবী সা: আরো বলেন, ‘আমি এমন এক দল নারীর কাছে এলাম, সাপ যাদের স্তনে দংশন করছে। আমি বললাম, এদের কী হয়েছে? সে বলল, এসব নারী তাদের সন্তানদের দুধ পান করতে বাধা দিত।’ (মুসতাদরাকে হাকিম-২৮৩৭) এ ছাড়াও তিনি অনেক আশ্চর্য বিষয় প্রত্যক্ষ করেছেন।
বিজ্ঞান-দর্শনে মিরাজ : মিরাজের এই বিস্ময়কর ঘটনা পরবর্তী সময়ে হাজার বছর ধরে অনেকেই বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে বিভিন্নভাবে অপব্যাখ্যা করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। তাদের দাবি- মিরাজ ছিল স্বপ্ন মাত্র, আসমান জগতে যে বিভিন্ন স্তরে বরফ, আগুন, বিষাক্ত গ্যাস ইত্যাদি রয়েছে যা ভেদ করে ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব, তারা এমনও বলে, মধ্যাকর্ষণ শক্তি অতিক্রম করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাদের এই দাবির মূল কারণ ধর্মীয় শিক্ষার অভাব।
তবে আধুনিক বিজ্ঞান সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে, জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে এরূপ অলৌকিক ঊর্ধ্বারোহণ অসম্ভব নয়। (খুতবাতুল আহকাম ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ.-২৫২) এ কথা দ্বারা বোঝা যায়, বিজ্ঞান যত উন্নত হবে, ততই তারা কুরআন-হাদিসের সারগর্ভ লাভ করবে।
করণীয় ও বর্জনীয় : মিরাজের রাতে বিশেষ কোনো আমল শরিয়তসম্মত নয়। ২৭ রজব রোজা রাখা, সালাতে রাগায়েব নামে বিশেষ সালাত আদায়- এ সংক্রান্ত সব হাদিসই জাল ও বানোয়াট। ফলে শবেমিরাজের নামে নফল সালাত আদায় করা এবং এর ব্যবস্থা প্রণয়ন করা মানে ইসলামী শরিয়তে নিজের পক্ষ থেকে কিছু সংযোজন করা। আর এ ব্যাপারে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে আমাদের ধর্মে এমন কিছু সংযুক্ত বা উদ্ভাবন করবে, যা তার (শরিয়তের) অংশ নয়- তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ (বুখারি-১/৩৭১)
এ রাত থেকে দৃঢ়প্রত্যয় করা দরকার, জীবনে কখনো আর সালাত তরক করব না, কোনোভাবেই শিরক-কুফরের সাথে যুক্ত হবো না।
অতএব মিরাজ উপলক্ষে পালিত উল্লিখিত বিদয়াতগুলো বর্জন করে, আল্লাহর নির্দেশ মেনে এ দিনের ও মাসের সম্মান অক্ষুণœ রাখা একান্ত কর্তব্য। মহান আল্লাহ আমাদেরকে মিরাজের প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করে শিরক-বিদয়াতসহ সর্বপ্রকার গর্হিত কাজ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, ডক্টর আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহ. প্রতিষ্ঠিত, জামেয়াতুস সুন্নাহ, ঝিনাইদহ সদর