প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর ও চাকরির আশ্বাসে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রতারণা
এস এম সাখাওয়াত শনিবার দুপুর ০২:২৮, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
“জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপনে ভূমিহীনদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর দেয়া হবে। দেয়া হবে প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, সমাজসেবায় বিভিন্ন সরকারি প্রশিক্ষণ। এছাড়াও সমাজসেবা অধিদপ্তরে কম্পিউটার অপারেটরসহ নানা পদে সার্কুলার ছাড়া হবে চাকরি। অফিসের সাথে সম্পর্ক ভালো তাই পদ ভেদে এক থেকে পাঁচ লক্ষ পর্যন্ত অগ্রিম টাকা লাগবে। আর চাকরির নিয়োগপত্র পাবার আগেই নেয়া টাকার বিনিময়ে দেয়া হবে একটি ফাঁকা চেক।”
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বারোঘরিয়া ইউনিয়নের বাগানপাড়া গ্রামের বাবুর স্ত্রী ফুলেরা বেগমের এমন আশ্বাসে ১ থেকে ৫ লক্ষ পর্যন্ত টাকা দিয়ে চাকুরি না পেয়ে ফেঁসেছেন জেলার কয়েক শত নারী।
এছাড়াও ১ হাজার থেকে ৫ হাজার পর্যন্ত টাকা দিয়ে বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড না পেয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন অন্তত ৪০ জন। তবে বিষয়গুলো পুরোপুরি স্বীকার না করলেও টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ফুলেরা বেগম। আর জেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর এমন প্রতারকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন।
জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি ছাড়াও সরকারী বিভিন্ন প্রকল্পের ভাতা পাইয়ে দেয়ার করে দেয়ার নাম করে স্থানীয়তো বটেই জেলার অনেকের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক ফুলেরা বেগম। তবে কয়েকজন নারী-পুরুষকে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ভাতার কার্ড করে দিলেও না পারার সংখ্যাটা বেশি। এমনকি ১৫-২০ জনকে কার্ড করে দিতে না পেরে টাকাও ফেরত দিয়েছেন। তবে এখনও অনেকেই প্রলোভনের চাকরি ও ভাতা বাবদ তার কাছে পাবে টাকা।
এ নিয়ে শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ফুলেরা বেগমের বাড়ি ঘেরাও করেন কয়েকজন নারী ভুক্তভোগী। এ সময় বাড়ির দরজা লাগিয়ে দিলে ভুক্তভোগীরা উত্তেজিত হন। উল্টো ভুক্তভোগীদেরকে নানারকম ভয়ভীতি ও হুমকি দেন ফুলেরা বেগম। এমনকি এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহে যাওয়া দৈনিক আমাদের মাতৃভূমি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি মো. জাহিদ হাসানের উপর হামলা করে ফুলেরা বেগমের ছেলে-মেয়ে। এ সময় গুরুতর আহত হন জাহিদ হাসান। পরে পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। এ সময় দুটি দেশীয় অস্ত্র হাতুড়ি ও সাবল উদ্ধার করা হয়।
সমাজ সেবা অধিদপ্তরে চাকরি করে দেয়ার নামে ফুলেরা বেগমকে ৫ লক্ষ টাকা দেয়ার দাবি করেছেন একই গ্রামের মাসুদ আলীর স্ত্রী মোসা. সায়েমা বেগম, ২ লক্ষ টাকা দিয়েছেন আব্দুল করিমের স্ত্রী খাতিজা খাতুন, ৩ লক্ষ টাকা দিয়েছেন বারোঘরিয়ার নুরুন্নাহার, ১ লক্ষ টাকা দিয়েছেন শফিকুল ইসলামের স্ত্রী শিরিন খাতুন। গ্রামের বিভিন্ন নারীদেরকে সমাজ সেবা অধিদপ্তরে চাকরি দেয়ার কথা বলে অগ্রিম টাকা নেয়ার পর দীর্ঘ দুই বছর পেরিয়ে গেলে টাকা ফেরত নেয়ার দাবি জানায় চাকরি প্রার্থীরা। তাদের এখন একটাই দাবী চাকরি লাগবেনা, টাকা ফেরত চাই।
এ বিষয়ে কথা হয় চাকরি প্রত্যাশী সায়েমা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, সমাজ সেবা অধিদপ্তরে পিয়ন পদে চাকরির পরিচয় দিয়ে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে দুই বারে ১ লক্ষ করে ২ লক্ষ ও একবার ৩ লক্ষ মোট ৫ লক্ষ টাকা নিয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরি দেয়ার কথা বলে ফুলেরা বেগম। বিনিময়ে অগ্রণী ব্যাংকের একটি ফাঁকা চেক দেয়। এর আগেও কয়েকজনের চাকরি করে দিয়েছে, আমারটাও করে
দিবে বলে জানায় টাকা নেয়ার সময়। তবে টাকা নেয়ার পর থেকেই দিব-দিচ্ছি করে করে দুই বছর পেরিয়ে গেলে টাকা ফেরত নেয়ার জন্য বারবার বলি। কিন্তু কাকে টাকা দিয়েছে, আর কখনইবা টাকা ফেরত দিবে কিছুই বলছে না। আমি ঋণ করে টাকা দিয়েছি। ইউনিয়ন পরিষদ ও থানায় অভিযোগ দিয়েও কোন সুরাহা না পেয়ে আদালতে চেকের মামলা দায়ের করেছি।
দুই লক্ষ টাকা দেয়া আব্দুল করিমের স্ত্রী খাতিজা খাতুন জানান, পাড়ার মানুষ বলে বিশ্বাস করে টাকা দিয়েছি। টাকা নেয়ার পর রাজশাহী ও গোদাগাড়ীতে প্রশিক্ষণ করাবে বলে দীর্ঘদিন ঘুরিয়েছে। শুধু আমাকেই না, অনেককেই এভাবে মিথ্যা কথা বলেছে। কিন্তু চাকরি প্রত্যাশীরা সবাই মিলে চাপ দিলে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করে ও ফেরত দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। সবার কাছে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য সময় নিয়েছে, কিন্তু সময় চলে গেলেও টাকা দিচ্ছে না।
একই এলাকার শিরিন খাতুন বলেন, টাকা লেনদেনের বিষয়ে ফুলেরার স্বামী-শ্বশুরকে অভিযোগ দিতে গেলে তারা বলে টাকা দেয়ার সময় আমাদেরকে বলে দেননি। অতএব এসব বিষয়ে আমাদেরকে জড়িয়ে লাভ নাই। তার স্বামী জানায়, তাকে (ফুলেরা) মেরে টাকা নেন। আমি জানি না এসব। শিরিন আরও বলেন, আমার নিজের চাকরির টাকা ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতার কার্ড করে দেয়ার নামে এলাকার
আরও কয়েকজনের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা ফুলেরাকে দিয়েছি। কার্ড না হওয়ায় ওইসব টাকাও আমাকে শোধ করতে হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল মালেক জানান, এলাকার অনেকের কাছ থেকেই বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দিব বলে ফুলেরা টাকা নিয়েছে। তবে কয়েকজনের ফেরত দিলেও, অনেকেই টাকা পাবে। প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু মানুষ তার বাসার সামনে এসে বসে থাকে টাকা ফেরত নেয়ার জন্য। করে হট্টোগোল। এমন খারাপ মেয়েদের জন্য এলাকাই বাস করাই এখন দায়।
তবে অভিযুক্ত ফুলেরা বেগম সমাজ সেবা অধিদপ্তরে চাকরি দেয়ার নামে টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এর আগেও এলাকার অনেকের বিভিন্ন ভাতার কার্ড করে দিয়েছি। আরও অনেকের কার্ড করে দেয়ার জন্য কাগজপত্র ও টাকা নিয়েছিলাম। সব সত্য। কিন্তু যাদের হয়নি তাদের টাকা ফেরত দিয়েছি।
চাকরির বিষয়ে তিনি বলেন, সমাজ সেবা অধিদপ্তরের এক ম্যাডামের মাধ্যমে এসব টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু চাকরি হয়নি। টাকাগুলো ফেরত দিব, তবে একটু সময় লাগবে। ম্যাডামের পরিচয় জানতে চাইলে এ বিষয়ে কথা বলবেন না বলে জানান তিনি।
এসব বিষয়ে কথা হয় বারোঘরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল খায়েরের সাথে। তিনি জানান, ফুলেরার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাৎ বিষয়ে অনেক অভিযোগ। আর তাই স্থানীয় লোকজনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে টাকা আদান-প্রদানের বিষয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ইউনিয়ন পরিষদে কয়েকবার সালিশ আহ্বান করা হলেও সে উপস্থিত হয়নি। পরে থানায় অভিযোগ করলেও কোন সমাধান পাননি ভুক্তভোগীরা।
এ নিয়ে বারোঘরিয়া গ্রামের মাসুদ আলীর স্ত্রী মোসা. সায়েমা বেগম বাদি হয়ে আদালতে একটি চেক জালিয়াতির মামলা দায়ের করেন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মাহবুব জানান, উত্তেজনাকর পরিস্থিতির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ভুক্তভোগীদেরকে শনিবার দুপুর ১২টায় থানায় উপস্থিত হয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে ভুক্তভোগীদের দাবি, গত কয়েকদিন আগেই ফুলেরা বেগমের নামে থানায় একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছে। তবে এনিয়ে পুলিশ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এছাড়াও আদালতে চেক জালিয়াতির একটি মামলা চলমান রয়েছে।
তবে সমাজ সেবা অধিদপ্তর চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক উম্মে কুলসুম মুঠোফোনে বলেন, ফুলেরা নামের কোন মহিলা সমাজ সেবা অধিদপ্তরে চাকরি করেন না। এমনকি এই নামের কোন মহিলাকেও তিনি ব্যক্তিগতভাবে চিনেননা।
এছাড়াও ভাতার কার্ডে টাকা লেনদেনের কোন সুযোগ নেই। এমনকি চাকরি দেয়ার নামে টাকা আদায়ের পর প্রতারণার বিষয়ে কিছু জানা নেই তার। আর এসব বিষয়ে আমাদের অফিসের কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা মনেয়ার আশ্বাস দেন তিনি।