রাজধানীর গণপরিবহনে ই-টিকিটিংয়ে স্বস্তিতে যাত্রীরা
নিজস্ব প্রতিনিধি সোমবার রাত ০২:২১, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২
মাহবুবা হোসেন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার একটি রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে (ডায়াগনস্টিক সেন্টার) টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। বাসা মিরপুর ১ নম্বরে। প্রতিদিন বাসে করে যাতায়াত করতে হয় তাকে। বললেন, সকালে দিশারি পরিবহনের বাসে ধানমন্ডি আসেন। ভাড়া দিতে হয় ২০-২৫ টাকা। রাতে ফেরার সময় আসাদগেট থেকে প্রজাপতি পরিবহনের বাসে যেতে ২০ টাকাই দিতে হতো। তবে দুই দিন ধরে প্রজাপতি বাসে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর ফলে রাতে ফেরার সময় এক দিন ১৩ টাকা, আরেক দিন ১৫ টাকা ভাড়া দিয়েছেন।
মাহবুবা হোসেন বলেন, দুই টাকা ভাংতি নেই বলে ১৩ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা ভাড়া নিয়েছে। এ ধরনের কাজ না করলে ভাড়া তো প্রায় অর্ধেক কমে যাচ্ছে। এটা খুবই ভালো হবে যাত্রীদের জন্য। শুধু স্টপেজে গিয়ে যাত্রী কোথায় যাবেন, তা বলার সঙ্গে সঙ্গে টিকিট বের করে তা হাতে তুলে দিচ্ছেন বিশেষ পোশাক গায়ে দেওয়া কর্মীরা। সব বাসে এটা চালু হলে ভোগান্তি অনেক কমে যাবে।
তানজিলা মোস্তাফিজ শ্যামলীতে একটি বেসরকারি সংগঠনে (এনজিও) কর্মরত। বছিলা থেকে তিনি প্রজাপতি বাসে করেই যাতায়াত করেন। ই-টিকিটিং চালুর বিষয়টিকে তিনি বিশেষ করে নারী যাত্রীদের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে দেখছেন। আগে অফিস শুরু ও ছুটির পর বাসে উঠতে হুড়োহুড়ি করতে হতো। এখন ই–টিকিট চালুর ফলে এই হুড়োহুড়ি হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী তোলার যে প্রতিযোগিতা ছিল, তা–ও আর হচ্ছে না। যাত্রীরা টিকিট কেটে দাঁড়াচ্ছেন; যে বাস আগে আসছে, সেই বাস যাত্রী নিয়ে চলে যাচ্ছে। ফলে বাসের ভেতর একটু বসে আরামে গন্তব্যে যাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি রাজধানীতে অতিরিক্ত বাসভাড়া আদায় নিয়ে বিভিন্ন সময় যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিরসনে ই-টিকিটিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় ঠেকাতে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে পরীক্ষামূলকভাবে চারটি পরিবহন কোম্পানিতে ই-টিকিটিং চালু হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর এটি চালু হয়। এতে সরকার নির্ধারিত হারে একজন যাত্রী যত কিলোমিটার যাবেন, তিনি ঠিক তত দূরত্বের জন্যই ভাড়া দেবেন।
মাহবুবা বা তানজিলা নতুন এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানালেও অনেক যাত্রী এখন পর্যন্ত এ পদ্ধতিকে সেভাবে স্বাগত জানাতে পারছেন না। আগে সড়কের যেকোনো জায়গা থেকে হাত তুললেই বাস থেমে যেত। বাসে চড়তে টিকিটের জন্য সময় নষ্ট করতে হতো না। এখন তো আর স্টপেজের বাইরে থেকে বাসে চড়াই যাচ্ছে না। তবে এই মনোভাব পোষণ করা বেশ কয়েকজন যাত্রীর স্বীকারোক্তি, বাসে চড়ার পর অবশ্য ভাড়া নিয়ে বাসের সহকারীর সঙ্গে প্রায় সময় তর্ক করতে হতো। টিকিট থাকলে যা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
পরিস্থানের কর্মী মো. কবির হোসেন হাতের ডিভাইস থেকে যাত্রীদের টিকিট দিতে দিতে বললেন, ঝামেলা বাড়ছে; আবার অনেক বেকারের কর্মসংস্থানও হইছে। এখন তো লোক বাড়াইতে হইতাছে প্রতি স্টপেজে।
কবির হোসেন জানালেন, বেলা দুইটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ২৩৬টি টিকিট ৩ হাজার ৬১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বললেন, কাজ শেষ হলে মালিকপক্ষের লোক এসে মেশিনে দেখবেন কত টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। এখন হিসাব রাখাটা সহজ হয়েছে।
ই-টিকিটিং চালুর ফলে বাসের কর্মীদের ব্যস্ততাও বেড়েছে। এইচএসসি পড়ুয়া ইয়াসিন আরাফাত মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে প্রজাপতি স্টপেজে বসে টিকিট দিচ্ছিলেন। এক মা ও স্কুলপড়ুয়া মেয়ে এসে কল্যাণপুরের টিকিট চাইলেন। টিকিট কাটার পর দেখা গেল, আগে মা ও মেয়ে যে ভাড়ায় যেতেন, এখন সে তুলনায় ভাড়া কিছুটা বেশি লাগছে। কেননা, আগে শিক্ষার্থী হিসেবে মেয়ের হাফ ভাড়া পাঁচ টাকা রাখা হলেও এখন ই-টিকিটিংয়ে সর্বনিম্ন ভাড়া রাখা হচ্ছে ১০ টাকা। এই মা প্রথমে টিকিট নিতে আপত্তি জানালেও পরে বাসে ওঠেন।
বেশির ভাগ যাত্রীর সঙ্গে কর্মীদের ঝামেলা হচ্ছে ভাংতি টাকা নিয়ে। ১৩ টাকা, ১৭ টাকা-এ ধরনের ভাড়া হওয়ায় যাত্রীরা যেমন ভাংতি দিতে পারছেন না; তেমনি স্টপেজের কর্মীরাও অনেক সময় টাকা ফেরত দিতে পারছেন না। ওই স্টপেজের আরেক কর্মী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ভাংতি টাকা নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছে। এতে অনেক সময় যাত্রীরা ভাংতি টাকা দিতে অস্বীকার করছেন। উপায় না থাকলে ওই দুই-তিন টাকা ছেড়ে দিতে হচ্ছে। এতে মালিকের ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়া মালিকপক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শুক্র-শনিবার যাতে কোনো শিক্ষার্থীর জন্য ভাড়া ছাড় দেয়া না হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা এসে টিকিট চাইলে না দিলে ঝামেলা শুরু করে দিচ্ছেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে চারটি পরিবহনে ই-টিকিটিং শুরু হয়েছে। প্রথম এ পদ্ধতি চালু করেছে মিরপুর-১২ নম্বর থেকে ঢাকেশ্বরীগামী মিরপুর সুপার লিংক, ঘাটারচর থেকে উত্তরাগামী প্রজাপতি ও পরিস্থান, গাবতলী থেকে গাজীপুরগামী বসুমতি পরিবহনের বাস। ২৮ সেপ্টেম্বর আরও তিনটি অছিম পরিবহন, রাজধানী পরিবহন ও নূরে মক্কা পরিবহনে এ ব্যবস্থা চালু হবে। সহজ ডটকম এবং যাত্রী নামের দুটি কোম্পানি এ কাজে সহায়তা করবে।
খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পরিবহন খাতকে নিয়মনীতির আওতায় আনার জন্য বিশাল কাজ হাতে নিয়েছি। পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট অনেকের স্বার্থে আঘাত লাগছে বলে এ কাজে বাধাও আসছে। তবে আমরা আপস করব না। আমাদের কাজ চালিয়ে যাব।
তিনি বলেন, আড়াই হাজার পরিবহন মালিককে সচেতন করতে বিভিন্ন সভা করছি। ই-টিকিটিং চালুর বিষয়টি জানিয়ে পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিদের কাছে চিঠি পাঠাচ্ছি সহযোগিতা চেয়ে। আপাতত ই-টিকিটিং চালুর বিষয়টি বাধ্যতামূলক না হলেও আস্তে আস্তে সব পরিবহনে বাধ্যতামূলক করা হবে।
এ ব্যবস্থায় মালিকেরা লাভবান হবেন কি না, এ প্রশ্নের জবাবে এনায়েত উল্যাহ বলেন, লাভ-ক্ষতির চেয়েও পরিবহন খাতে সরকার নির্ধারিত যে ভাড়া আছে, তা যাতে কার্যকর হয় ও পরিবহন খাতকে নিয়মনীতির আওতায় আনার জন্যই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত যাত্রীদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া প্রসঙ্গে এনায়েত উল্যাহ বলেন, সরকারের নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া হচ্ছে ১০ টাকা। তবে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় আছে।
ডিজেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমার পর গত ৩১ আগস্ট বনানীতে বিআরটিএ কার্যালয়ে বাস-মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ সংক্রান্ত সভা শেষে ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেন এনায়েত উল্যাহ।
প্রজাপতি পরিবহন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, যাত্রীদের বেশির ভাগেরই প্রবণতা হচ্ছে হাত তুলে থামিয়ে বাসে চড়া। অনেকেই চালাকি করে ১০ টাকা দিয়ে ২০ টাকার দূরত্বে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাই নতুন পদ্ধতি কার্যকর হতে সময় লাগবে। বিষয়টি নজরদারির আওতায় আছে।
রফিকুল ইসলাম জানালেন, ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করতে মালিকদের কমপক্ষে ২০ শতাংশ জনবল বাড়াতে হচ্ছে। কম দূরত্বের গন্তব্যে যেতে যাত্রীদের খরচ আগের তুলনায় অনেক কমে যাবে। স্টপেজ ছাড়া যাত্রী না তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে মালিকের ক্ষতি হবে না। সবচেয়ে বড় কথা, পরিবহন খাতের নৈরাজ্য কমবে।