ঢাকা (দুপুর ১২:০৯) সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ ইং

ব্যভিচারকারীদের শাস্তি সম্পর্কে কি বলে ইসলাম ধর্ম



হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকীঃ  ইসলাম শাশ্বত, অবিনশ্বর-চিরন্তন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। দুষ্টের দমন শিষ্টের লালন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইসলামী জিন্দেগির পরতে পরতে ইনসাফ বা ন্যায়নীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের অসংখ্য জায়গায় এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় বক্তব্য রয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ তা’আলাই সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। পবিত্র কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “আল্লাহ তা’আলা কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম বিচারক নন?” [আল কুরআন ৯৫ঃ৮]
অন্যত্র এসেছে- “আর তিনিই সর্বোত্তম হুকুমদাতা ও শ্রেষ্ঠ বিচারক।” [আল কুরআন ৭ঃ৮৭]
আর তাইতো মানব জীবনে আল্লাহর দেয়া বিধি বিধানই শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম। এ বিধান মেনেই জীবন পরিচালনা করতে হবে। অন্যথায় ইনসাফের ওপর কায়েম থাকা যাবে না। আর আল্লাহর নির্দেশও তাই। মহান আল্লাহ এরশাদ করেন- “নিঃসন্দেহে আল্লাহ তোমাদেরকে ন্যায় বিচার ও সদাচরণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন।” [সুরা আন নাহল, আয়াত- ৯০]
শুধু কি তাই? আমানতকারীর আমানত খেয়ানত করা যাবেনা। যথাসময়ে প্রাপ্য বস্তু ফেরত দিতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন, আমানত তার হকদারকে ফেরত দাও। তোমার যখন মানুষের মধ্যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে তখন ন্যায় পরায়ণতার সাথে বিচার করবে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে উপদেশ দেন তা উৎকৃষ্ট। আল্লাহ সবকিছু শুনেন এবং দেখেন।” [সুরা নিসা, আয়াত ৫৮]
যুগে যুগে আল্লাহ যত নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন তার উদ্দেশ্য সমাজে ন্যায় নিষ্ঠতা ও সুশৃঙ্খলার বিধান করা। মানুষের মাঝে যেমন হায়েনার চরিত্র বা পশুত্ব রয়েছে তেমনি ফেরেশতা সুলভ সুকুমার বৃত্তি ও রয়েছে। পশুত্বের ওপর সুন্দর গুণাবলীকে জাগিয়ে তোলাই নবী, রাসুল, আওলিয়া, আম্বিয়ার কাজ। নবী রাসুল প্রেরণের প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, অত্যাচারী-অসভ্য-বর্বর লোকদেরকে সুসভ্য, ন্যায়ানুগ-সুশৃঙ্খল করাই ছিল তাদের কাজ। কুরআনেও এর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আমি আমার রাসুলগণকে প্রেরণ করেছি স্পষ্ট প্রমাণসহ, আর নবীগণের নিকট আমি নিরপেক্ষ ও নির্ভরযোগ্য মানদন্ড নাজিল করেছি। যেন মানুষ এ সবের সাহায্যে পরস্পরের মধ্যে সুবিচার ও ইনসাফ কায়েম করে।”
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে আল্লাহ ইনসাফ কায়েমের নির্দেশ দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এরশাদ হয়েছে- “হে নবী আপনি বলে দিন, আল্লাহ যে কিতাব আমার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন আমি তাতে বিশ্বাস করি। আর আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তোমাদের মধ্যে সুবিচার কায়েম করার জন্য। আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের প্রতিপালক।” [সুরা আশশুআরা, আয়াত- ১৫]
রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর ৬৩ বছর হায়াতে তা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং কীভাবে তা প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা বাতলে গেছেন। এর দ্বারা যে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি একবার হযরত ওমর রা. কে একটি এলাকার বিচারক করে পাঠালেন। তিন বছর পর হযরত ওমর রা. চাকুরী থেকে ইস্তফা চেয়ে বললেন, হে আল্লাহর নবী ঐ জনপদের লোকজন এত ভাল হয়ে গেছেন যে, সুদীর্ঘ তিন বছরে আমার আদালতে কোন মামলা আসেনি। তবে সুবিচার প্রতিষ্ঠায় আল্লাহর এই নির্দেশ কেবল রাসুলুল্লাহ সা. এর জন্যই নয় বরং শাসক-শাসিত সর্বশ্রেণীর লোকের জন্যই। পরিবারের কর্তাব্যক্তি যদি ছেলেকে বেশি খেতে দেন এবং অতি আদর করেন আর কন্যা সন্তানকে কম আদর ও কম খেতে দেন তাও বে ইনসাফী। ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় কারো প্রতি বিদ্বেষ ও অন্ধভক্তি কোনভাবেই কাম্য নয়। একচোখা নীতি বর্জন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায় বিচারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাক এবং আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও। যদিও এটা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের বাবা, মা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে যায়। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাঁদের চেয়েও বেশি কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকোনা। আর যদি তোমরা পেচানো কথা বলো অথবা সত্যকে পাশ কেটে চলো, তাহলে জেনে রেখো তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন।” [সুরা নিসা, আয়াত- ১৩৫]
আল্লাহ পাক আরো এরশাদ করেন, “হে মুমিনগণ! আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্যদানে তোমরা অবিচল থাকবে। নির্দিষ্ট কোন দলের বা জাতির বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে তাদের প্রতি অবিচার করতে প্ররোচিত না করে। তোমরা নির্বিশেষে সকলের প্রতি সুবিচার কর, কারণ এটা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী। জেনে রেখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজের খবর রাখেন।” [সুরা মায়েদা, আয়াত- ৮]
উপরোক্ত আয়াতে কারিমা থেকে বুঝা গেল কেবল ন্যায় বিচারের নির্দেশ শুধু রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রনায়কের জন্যই নয়; বরং দলমত নির্বিশেষে সকলের প্রতি। সকলকেই ন্যায়ানু বা ইনসাফপূর্ণ কাজের নির্দেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ তাআলা। তবে যারা উল্টা পথে কিংবা অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয় তাদের পরিণতি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ও করুণ। তাদের প্রতি চরম হুশিয়ারি রয়েছে। অবশ্যই পরকালে এর সাজা হবে। আল্লাহ পাক বলেছেন- “ তোমরা সেদিনকে ভয়কর যেদিন কেউ কারো কোন কাজে আসবে না, কারও সুপারিশ গ্রহণ করা হবেনা, কারও নিকট হতে বিনিময় গ্রহণ করা হবে না এবং কোন সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না।” [সুরা বাকারা, আয়াত- ৪৮]
অনুরূপভাবে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “(সে দিনকে ভয় কর) যেদিন ফেরেশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, দয়াময় যাকে অনুমতি দেবেন সে ব্যতীত কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। সে সত্য কথাই বলবে। এদিনটি আসবেই তাতে কোন সন্দেহ নেই। যার ইচ্ছা হয় সে তার প্রতিপালকের নিকটবর্তী হতে পারে। আমি তোমাদেরকে আসন্ন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করলাম। সেদিন মানুষ তার কৃতকর্ম প্রত্যক্ষ করবে। আর মিথ্যাবাদীরা বলবে হায়, আজ আমি যদি মাটি হয়ে যেতাম।” [সুরা নাবা, আয়াত ৩৮-৪০]
কতইনা ভয়ংকর হবে হিসাব নিকাশের দিন। সেদিন কারো কোন আশ্রয় থাকবে না। মানুষ তার আত্মীয়তার বন্ধন ভুলে যাবে। কেউ কাউকে চিনবে না। একে অপরের নিকট থেকে পলায়ন করবে। সত্যই তা অত্যন্ত ভয়ানক ও কঠিন পরিস্থিতি। যেমনটি আল্লাহ বলেন- “শেষ বিচারের দিন মানুষ তার ভাই থেকে পলায়ন করবে এবং তার মাতা-পিতা থেকে তার স্ত্রী ও তার সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যকের অবস্থা এত গুরুতর হবে যে, সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে।” তাই এটা ঈমানের দাবী ও পূর্বশর্ত। এছাড়া মুমিন নিজেকে মুমিন হিসেবে পরিচয় দিতে পারবে না। আল্লাহ বলেন- “এবং যারা আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সে অনুসারে বিচার ফয়সালা করেনা তারাই কাফের।” অন্যত্র তাদেরকে জালেম আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদেরকে ফাসেকও বলা হয়েছে। তাই সর্বদা ন্যায় ও ইনসাফের ওপর সুদৃঢ় থাকতে হবে। নতুবা কঠিন শাস্তির মুখোমুখী হতে হবে। যেমন রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন- “তিন প্রকারের বিচারক রয়েছে, তার মধ্যে এক প্রকার মাত্র জান্নাতে যেতে পারবে। অপর দুই প্রকার জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবে।
১. যে বিচারক জান্নাতে যাবে সে এমন ব্যক্তি, যে প্রকৃত সত্যকে জানতে পেরেছে, অতঃপর সত্যের পক্ষে রায় দিয়েছে।
২. যে বিচারক জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবে। সে হল ঐ বিচারক যে প্রকৃত সত্য জানতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে তারপরও অবিচার করেছে জুলুম করেছে।
৩. আরেক বিচারক জাহান্নামে যেতে বাধ্য হবে, সে হল ঐ বিচারক যে অজ্ঞতা সত্বেও জঞ্জালের জন্য বিচার ফয়সালা করেছে, সেও জাহান্নামি।” এই হাদিস থেকে প্রতীয়মান হয় যে, বিচার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজ জেনে শুনে বুঝে তার পর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোন রকম খেয়ালিপনা চলবে না; বরং সুন্দর ও সুচারুরূপে যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। ন্যায়ের পথে কথা বলতে হবে। অন্যায়কে প্রতিরোধ করতে হবে। নিজের ভাইও যদি জুলুম করে তাকেও প্রতিরোধ করতে হবে। হযরত উবাদাতা ইবনে সামিত রা. থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সা. এরশাদ করেছেন- ‘দণ্ডসমূহ কার্যকর কর। আর আল্লাহর ব্যাপারে কোন জালেমের জুলুম যেন তোমাদেরকে এ দণ্ডসমূহ কার্যকরী করা থেকে বিরত রাখতে না পারে।
ইয়া আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বিচার করার তৌফিক দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।

লেখকঃ প্রিন্সিপাল শাহজালাল রহ, ৩৬০ আউলিয়া লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা উপশহর সিলেট।

শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT