ঢাকা (রাত ১০:২১) শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
শিরোনাম

কারবালার রক্তঝরা এক হৃদয় বিদারক ইতিহাস



‘ইসলাম জিন্দা হোতে হে হার কারবালাকে বাদ’ অর্থাৎ ইসলামের পুনর্জাগরণ হয় প্রতিটি কারবালার পরই।

কোনো এক উর্দু কবির এ প্রবাদটিই তুলে ধরে কারাবালার ইতিহাস ও মর্মকথা। যে ইতিহাস রক্তঝরা ইতিহাস, যে ইতিহাস ভূবন কাঁদায়, যে ইতিহাস সত্যের পথে লড়াইয়ের শক্তি জোগায়, শিরায় উপশিরায় ইসলামের প্রতি ভালোবাসাকে জাগিয়ে তুলে। জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনা জাগায়।

কী ঘটেছিল সেদিন কারবালার প্রান্তরে? নবী দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর সঙ্গে কী আচরণ করেছিল ইসলামের চির শক্র ইয়াজিদ বাহিনী? বড়ই মর্মম এ ইতিহাস। বড়ই করুণ সে গল্প। এটি মুসলিম জাতির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ও বেদনাদায়ক ঘটনা।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.); মহানবীর (সা.) প্রিয় দৌহিত্রই ছিলেন না শুধু, ছিলেন তার আদর্শের প্রতীকও। আর সে জন্যই তিনি ইয়াজিদের সঙ্গে আপস করেননি। বরং তার স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দীনের ঝাণ্ডা হাতে নিয়ে প্রমাণ করে গেছেন ‘শির দেগা, নেহি দেগা আমামা’।

৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম কারবালার যুদ্ধ সংঘটিতে হয়েছিল। সেদিনই শাহাদাত বরণ করেন ইমাম হোসাইন (রা.)। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, চরিত্রহীন ইয়াজিদ যখন ক্ষমতার জোরে সত্য-ন্যায়ের মসনদে চেপে বসেছিল, তখন সমাজ ছেয়ে গিয়েছিল অনাচারের বিষ বাষ্পে। ইয়াজিদ ভুলে গিয়েছিল তাকওয়া-তাহারাত। খোদাভীতি ও ইবাদত। সে খোদার বিধানকে তোয়াক্কা না করে লিপ্ত হয়েছিল বেগানা নারীগমনে। অসহায়দের সেবার পরিবর্তে সে খুলেছিল আমোদ-প্রমোদের দুয়ার।

তার এসব কার্যকলাপে কুফার লোকেরা অসন্তুষ্ট হয়ে ইমাম হোসাইনের (রা.) এর কাছে চিঠি পাঠিয়ে জানালো যে, তারা মুসলিম জাহানের ইমাম হিসেবে ইয়াজিদকে নয়, হজরত হোসাইন (রা.) কেই চায়। তাদের চিঠি পেয়ে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) কুফার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার জন্য চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে (রা.)-কে পাঠালেন। হজরত মুসলিম (রা.) কুফায় এসে দেখলেন ঘটনা সত্য। এখানকার অধিকাংশ লোকই হজরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে চাচ্ছেন। তিনি দ্রুত সেই খবর ইমাম হোসাইনকে (রা.)-কে জানালেন।

এক মুনাফিকের মাধ্যমে এ খবর ইয়াজিদের কাছে পৌঁছলে সে কুফার গভর্নর নোমান বিন বাশিরকে বরখাস্ত করে তার জায়গায় উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে বসান। আর বলে দিল, ‘তুমি বসরার গভর্নর, পাশাপাশি কুফারও গভর্নর। অতএব, তুমি মুসলিম বিন আকীলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করো।’ ইবনে যিয়াদ ছিল ক্ষমতালোভী ও কঠোর প্রকৃতির লোক। সে কুফায় এসেই মুসলিম (রা.) এর হাতে বায়াত হওয়া অনুসারীদের থেকে নেতৃস্থানীয়দের গ্রেফতার করা শুরু করে।

এ অবস্থায় হজরত মুসলিম (রা.) সবার সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর ভবন ঘেরাও করলেন। সেদিন অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তিনি ইশারা দিলেই গভর্নর ভবন ধূলিসাৎ হয়ে যেত। অবস্থা বেগতিক দেখে চতুর যিয়াদ ফন্দি করে বন্দিদের বলে যে, তোমরা গভর্নর ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে বলো, তারা যদি ঘেরাও প্রত্যাহার না করে তবে তোমাদের জবাই করে হত্যা করা হবে। বন্দিরা প্রাণ বাঁচাতে তা-ই করল। তাদের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই হজরত মুসলিমের (রা.) এর হাতে বাইয়াত হওয়া ৪০ হাজার অনুসারী আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকারে তলাতে লাগল। আর এ সুযোগ পেয়ে ইবনে যিয়াদ সত্যের বাহক হজরত মুসলিম (রা.)-কে গ্রেফতার করে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহীদ করে ফেলে।

এদিকে হজরত হোসাইন (রা.) তার স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়স্বজন, এমনকি দুগ্ধপোষ্য শিশুসহ প্রায় ৭৩-৭৪ জনের একটি কাফেলা নিয়ে মক্কা শরিফ থেকে কুফার দিকে রওনা হন। মাঝপথে এসে চাচাতো ভাই মুসলিম (রা.) এর শহীদ হওয়ার সংবাদ পেলেন। কিন্তু তিনি যে ভীরু নন। তিনি তো আসাদুল্লাহিল গালিব, আলী ইবনে আবী তালিবের রক্ত। মহানবীর (সা.) এর আদর্শের রক্ষাকবচ। তাই তিনি ভয়ে পিছপা হলেন না। বরং বীরবিক্রমে সামনে অগ্রসর হলেন। অতঃপর কুফা থেকে দু’মঞ্জিল দূরে কারবালা প্রান্তরে তাঁবু টানালেন। অসত্যের মূলোৎপাটনে সত্যের তলোয়ার ধরলেন। শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।

কিন্তু হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর বাহিনীর লোকজন কম হওয়ায় তারা শহিদ হতে শুরু করলেন। অপর দিকে শত্রুরা ইমাম হোসাইনের পবিত্র বদনে বৃষ্টির মতো তীর-বর্শা নিক্ষেপ করতে থাকে। আঘাতে আঘাতে তিনি রক্তে রঞ্জিত হলেন। একসময় আঘাত সহ্য করতে না পেরে ঘোড়া থেকে জমিনে পড়ে গেলেন। তখন নির্দয় সিমারের নির্দেশে জাহান্নামি সেনা ইবনে আনাস নখয়ী হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর মাথা মোবারক তাঁর শরীর মোবারক থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। আহা! কী হৃদয়বিদারক ছিল ইমাম হোসাইন (রা.) এর সেই শাহাদাত। যা আজও পৃথিবীতে ত্যাগ ও সত্যের পক্ষ্যে লড়াইয়ে অমর হয়ে আছে।

কারবালার শিক্ষা:

সেদিন হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বশ্যতা মেনে নিলে হয়তো তিনি ও তার পরিবার বেঁচে যেতেন। কিন্তু মহানবী (সা.) এর দাঁত ভেঙে যাওয়ার বিনিময়ে পাওয়া দ্বীন ও ধর্মের কী হতো? সেদিন যদি তিনি নীরবে সব মেনে নিতেন, তাহলে এই তেরশ’ বছর পর এসে আমরা মহানবীর (সা.) রেখে যাওয়া এই অক্ষুণ্ণ দ্বীনকে পেতাম কি?

তিনি তো মুসলিম জাতিকে শিখিয়ে গেছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ জীবন দিয়ে হলেও করতে হয়। না হলে পরবর্তী সময়ে দুঃশাসকদের ব্যাপারে আমরাও হতাম নীরব সমর্থক। কেননা তখন তো আর আমাদের সামনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইমাম হোসাইনের (রা.) দৃষ্টান্ত থাকত না। থাকত না মাথা উঁচু করার সাহস। দহনে দহনে অঙ্গার হয়ে গেলেও আমাদের মনোভাব হতো, এটাই বুঝি হওয়ার ছিল।

কিন্তু হজরত হোসাইন (রা.) তা হতে দেননি। তিনি বিশ্ব মুসলিমের জন্য এই শিক্ষাই রেখে গেলেন যে, অযোগ্য ও অসৎ ব্যক্তির অন্ধ আনুগত্য চলবে না। নিরব থাকাও চলবে না। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, বিশ্ব মুসলিম আজ হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) এ শিক্ষা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। আর সে জন্যই আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দেখছি মুসলিমদের হাহাকার। শুনছি দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

কারবালার যুদ্ধের প্রেক্ষাপট এতই বিস্তৃত যে, তা স্থান ও কালকে অতিক্রম করে বর্তমান সময়ে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বলেছেন, ‘আমি সৎকাজের আদেশ দান ও অসৎ কাজে বাধা প্রদানের উদ্দেশ্যে সংগ্রামে নেমেছি।’ সে হিসেবে বলা যায়, হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নৈতিক ও মানবীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার লক্ষ্যেই এই আন্দোলন ও যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

কারবালার যুদ্ধে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীরা ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছেন। কারবালায় শাহাদতের কয়েক দিন আগে থেকেই তিনি সঙ্গীদের ধৈর্য ধারণের শিক্ষা দিয়ে আসছিলেন। মহান আল্লাহর ওপর নির্ভরতা ও তার প্রতিশ্রুত পুরস্কারপ্রাপ্তির আশায় তার সঙ্গীরাও এ ব্যাপারে ছিলেন দৃঢ়চিত্ত। হজরত হোসাইন (রা.) এর সঙ্গীরা কারবালার ময়দানে আনুগত্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।

যুদ্ধের আগের রাতে তিনি সঙ্গীদের লক্ষ্য করে বলেন, যার ইচ্ছা সে চলে যেতে পারে। কারণ, তার সঙ্গে থাকার অর্থ হচ্ছে নির্ঘাত মৃত্যু। কিন্তু সঙ্গীরা আনুগত্যের শপথ করে তাকে ত্যাগ করবেন না বলে ঘোষণা দেন। মুসলিম ইবনে উজ্জাহ নামে এক সঙ্গী বলেন, ‘আমাকে যদি একবার হত্যা করে পুনরায় জীবিত করা হয় এবং ৭০ বার এ প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটানো হয়, তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আমি নিজের জীবন দিয়ে আপনাকে রক্ষার চেষ্টা করব, যাতে কিয়ামতের ময়দানে বিশ্বনবী (সা.)-কে বলতে পারি, নিজের অস্তিত্ব দিয়ে আমি আপনার বংশধরকে রক্ষার চেষ্টা করেছি!’

কারবালার ময়দানের এসব ঘটনা প্রমাণ করে হজরত হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীরা পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার মাধ্যমে মহান আল্লাহর আরো কাছে পৌঁছতে সচেষ্ট ছিলেন। শত্রু শিবিরকে উপদেশ দান অথবা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সময় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তার সঙ্গীরা বিন্দুমাত্র মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিসর্জন দেননি। তার শিবিরে যখন পানি ছিল, তখন তিনি পিপাসার্ত শত্রুসেনাদের তৃষ্ণা মেটাতে কার্পণ্য করেননি। আবার যুদ্ধের ময়দানে চরম সাহসিকতার সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) এ নমনীয়তা ও দৃঢ়তা প্রমাণ করে তিনি অতি উচ্চ লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। মানবতার মুক্তি এবং মানবীয় ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করাই ছিল হজরত ইমাম হোসাইনের (রা.) এর উদ্দেশ্য। এই মহান লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তা কিয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না বলে ইমামের শিক্ষা মানব জাতির পাথেয় হয়ে থাকবে চিরকাল।

তাই আসুন! আমরাও কারবালার ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিই। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর আদর্শে নিজেদের গড়ি। শপথ নিই পুরো পৃথিবীও যদি অসত্যের পক্ষ্যে নেয়, তবুও আমরা এ মিথ্যার মোকাবেলায় পরোয়াহীনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বো। এটাই যে কারবালার দীপ্ত শপথ।

কারবালা ও আশুরা মাঝে সম্পর্ক কী?

বর্তমানে দেখা যায় প্রায় সব মহল থেকে আশুরার মূল বিষয় বলে কারবালার ঘটনাকেই বুঝানো হচ্ছে। কিন্তু পবিত্র কোরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিকোণ থেকে এটা সঠিক নয়। ইসলাম আগমনের পূর্বেও আশুরা ছিল। আমরা হাদীস দ্বারা জানতে পেরেছি, তখন মক্কার মুশরিকরা আশুরার রোজা পালন করত; তেমনি ইহুদীরা হজরত মুসা (আ.) এর বিজয়ের স্মরণে আশুরার সওম পালন করত।

মহান আল্লাহর রাসূল হজরত মুহম্মদ (সা:) আশুরার রোজা পালন করেছেন জীবনের প্রতিটি বছর। তার ইন্তেকালের পর তার সাহাবায়ে কেরাম (রা.) আশুরা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা:) এর ইন্তেকালের প্রায় পঞ্চাশ বছর পর হিজরি ৬১ সালে কারবালার ময়দানের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

মহান আল্লাহর রাসূল হজরত মুহম্মদ (সা:) ও তার সাহাবায়ে কেরাম যে আশুরা পালন করেছেন ও যে আশুরা উম্মতে মুহম্মদীর জন্য রেখে গেছেন তাতে কারবালার ঘটনার কোনো ভূমিকা ছিল না। থাকার প্রশ্নই আসতে পারেনা।

কারবালার এ দুঃখজনক ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর সাহাবাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.), আব্দুল্লাহ বিন ওমার (রা.), আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.), আনাস বিন মালেক (রা.), আবু সাঈদ খুদরী (রা.), জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা.), সাহল বিন সায়াদ (রা.), যায়েদ বিন আরকাম (রা.), সালামাতা ইবনুল আওকা (রা.)-সহ বহু সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম জীবিত ছিলেন। তারা তাদের পরবর্তী লোকদের চেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা:) ও তার পরিবারবর্গকে অনেক বেশি ভালবাসতেন।

তারা আশুরার দিনে কারবালার ঘটনার কারণে কোন কিছুর প্রচলন করেননি। মাতম, তাযিয়া মিছিল কোনো কিছুরই প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারবালায় যারা শহীদ হয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা যেন তাদেরকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন, ও আমাদের সকলকে মহান আল্লাহ তায়ালা যেন কারবালার শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের জীবনকে সুন্দর করার তৌফিক দান করুন–আল্লাহুম্মা আমিন।


লেখকঃ-হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী;সাবেক ইমাম ও খতীব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ;সিলেট
শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT