চাঁপাইনবাবগঞ্জে ঔষধ সিন্ডিকেটে দিশেহারা ক্রেতা
এস এম সাখাওয়াত বৃহস্পতিবার রাত ০৮:৩৫, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
চাঁপাইনবাবগঞ্জে “সিন্ডিকেট” করে সর্বোচ্চ দামে ঔষধ বিক্রি করছেন ঔষধ ব্যবসায়ীরা। এতে ঔষধের প্যাকেটের গায়ে বা মোড়কে লেখা মূল্য পরিশোধে বাধ্য হচ্ছেন ক্রেতারা। ফলে জীবন বাঁচাতে ঔষধ ক্রয়ে দিশেহারা সাধারণ ক্রেতারা। অথচ দেড় বছর আগেই জীবন রক্ষাকারী ঔষধ কিনলে ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে মূল্য ছাড় দিতেন ব্যবসায়ীরা।
কিন্তু কথিত “ওষুধের অনিয়ম দূরীকরণ কমিটি” গঠন করে নিজেদেও স্বার্থে এই মূল্য ছাড় বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখার কার্যকরী পরিষদ। অথচ আশেপাশের জেলাগুলোতে এখনও ছাড়কৃত মূল্যে ঔষধ বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এই পরিস্থিতির অবশান চেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাপতেও ঔষধে মূল্য ছাড় দিতে সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ক্রেতা সাধারণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৭ এপ্রিল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার কার্যকরী পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে ঔষধ বিক্রির অনিয়ম দূরীকরণ কমিটির মূল্যায়ন সভাও হয়। ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাজারে প্রচলিত সকল ঔষধ মোড়কে লিখিত নির্ধারিত মূল্যেই বিক্রি করতে হবে। এর ব্যাতয় ঘটলে কিংবা কোনো ফার্মেসি ব্যবসায়ী ঔষধের মূল্য কম নিলে আর তা কমিটি জানতে পারলে সাথেসাথে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। যখন কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতি এ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ঠিক তখনও জেলার সর্বত্রই ঔষধ ক্রয়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ হারে মূল্য ছাড় পাচ্ছেন ক্রেতারা। পরে সমিতির সিদ্ধান্ত জেলা উপজেলার সব ফার্মেসিতে নোটিশ আকারে পাঠানো হলে জেলা জুড়ে বন্ধ হয়ে যায় ঔষধের ছাড়। ক্রেতারা হয়ে পড়েন দিশেহারা। কারণ নোটিশে ছাড় মূল্যে ঔষধ বিক্রি করলে জরিমানাসহ অন্যান্য শাস্তির হুশিয়ারি দেয়া হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকায় ঔষধ পাড়া বলতে শহরের বড় ইন্দারা মোড় ও সদর হাসপাতাল এলাকা বুঝালেও বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) শান্তির মোড়, নিউ মার্কেট এলাকা, পাওয়ার হাউস মোড় এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়।
পৌর এলাকার ১৫ নং ওয়ার্ডের ৭৭ বছর বয়সী বাসিন্দা মো. তাহির জামিল বড় ইন্দার মোড়ের একটি ফার্মেসি থেকে প্রায়ই ঔষধ কিনেন। কিন্তু মেলেনা কোন ছাড়। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, আমার নিজের ও আমার স্ত্রীর মিলে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার ঔষধ কিনি। কিন্তু আগে দিলেও গত প্রায় এক বছর থেকে এক টাকাও ছাড় পাই না। বলে কিনা তাদেও সমিতি এটা বারণ করেছে। জানতে পারলে নাকি তাদেও সাজা দিবে। অথচ শারিরীক চেকআপে মাঝেমাঝে আমাকে রাজশাহী যাওয়া লাগে। সেখানে ঔষধ কিনলে ১০ পার্সেন্ট কখনো কখনো ১২ পার্সেন্ট পর্যন্ত ছাড় দেয় তারা।
পৌর এলাকার শান্তির মোড়ে আছে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক। সে মাতাবেক গড়ে উঠেছে অনেক ছোট ছোট ফার্মেসী। এই এলাকায় চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার মহারাজপুর ডোলপাড়ার দিন মজুর রহমত হোসেন ফার্মেসি মালিকদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বছরের পর বছর ফার্মেসি মালিকরা সিন্ডিকেট করে হামারঘে পকট কাটছে। আর হামরা কাউকে কিচ্ছু কহিতে পারছি না’।
মেয়ের সার্জারীর জন্য সেবা ফার্মেসীতে ঔষধ কিনতে আসা শিবগঞ্জ উপজেলার মর্দানা গ্রামের আয়েশা বেগম বলেন, ‘হামার বেটির সিজার হোবে। তাই অকে সেবা ক্লিনিকে ভর্তি কইরাছি। ডাক্তার কি লিবে ওইসোধ কিনতে ফকির হয়ে গেনু। এত্তো দাম লিছে দোকানদাররা যে হামার ওষুধ কিনতে কিনতেই হামার লাভিশ্বাস উইঠা যাইছে। কে বুঝে কার কষ্ট। কৈ এত্তো এত্তো যে আন্দোলন হইলো ছাত্ররা সব জায়গায় অভিযান চালাইলে ওইষোধের দাম কেনে কমাইতে পারলেনা ? কেনে ওরঘে সিন্ডিকেট ভাঙার চেষ্টা করছে না ?’
নাম না প্রকাশ শর্তে একজন ফার্মেসি মালিক বলেন, ‘কোন কোন ক্রেতার আর্থিক অবস্থা দেখে খুবই কষ্ট হয় আমাদের। কিন্তু কিচ্ছু করার থাকেনা। আমি যদি ২ শতাংশ ছাড় দেই আর সেটা যদি কোন কারণে কেউ জেনে সমিতিতে অভিযোগ করেন তাহলেই আমার লাইসেন্স নিয়ে নানারকম ঝামেলা করবে সমিতি। আর তাই ঝামেলা এড়াতে দু:স্থ-অসহায় রোগিদেরও কোন রকম ছাড় দিতে পারি না’।
এ সকল বিষয় নিয়ে জেলা কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস্ সমিতির আহŸায়ক মো. মশিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করেই এমআরপি অনুযায়ী ঔষধ বিক্রির সিদ্ধান্ত হয় ঔষধ বিক্রির অনিয়ম দূরীকরণ কমিটির মূল্যায়ন সভায়। সমিতির কেন্দ্র থেকেও আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বলে। ব্যবসায়ীরা কোম্পানি থেকে যে কমিশন পায় সেখান থেকে আবার মূল্য ছাড় দিলে কিছুই থাকে না। ব্যবসায়ীদেরও তো লাভ করতে হবে। এই দূর্মূল্যেও বাজারে তাদের নিজেদের পরিবার, কর্মচারীদের পরিবার চালানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। আর তাই এমআরপি অনুযায়ী ঔষধ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
যদি সমিতির কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত হয় তবে পাশর্^বর্তী রাজশাহী জেলা ও নওগাঁ জেলাতে কেন এই সিদ্ধান্ত নেই এমন প্রশ্নের জবাবে মশিউর রহমান বলেন, নওগাঁয় আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু রাজশাহীতে এখনো মূল্য ছাড়েই ঔষধ বিক্রি চলছে। এটা তাদের সমিতির সিদ্ধান্তের ব্যাপার। আমরা তো সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারি না।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে সর্বোচ্চ মূল্যে ঔষধ বিক্রির ব্যাপারে অবগত আছেন উল্লেখ করে জেলা ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক জেড এম নাহিদ নাহিয়ান জানান, ঔষধের মূল্য নির্ধারিত মূল্যের বেশি নেয়া যাবে না। তবে কেউ যদি কম নিতে চান সে বিষয়ে ঔষধ প্রশাসনের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা জেলা কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সিদ্ধান্ত। তারা চাইলে কিছু মূল্য ছাড় দিতেই পারে। এতে আপামর সাধারণ মানুষের উপকার হয়।