শিশু সুরক্ষা ও আমাদের করণীয়
রমেশ চন্দ্র সরকার রবিবার রাত ১০:২৮, ২৫ জুলাই, ২০২১
আজকের শিশু আগামীর ভবিষ্যৎ। বাক্যটি আমরা সহসাই বলে থাকি। কিন্তু শিশুদের জীবন নামক ফুলটি যখন অকালে ঝরে যায় তখন ভবিষ্যতের বাকি থাকে কি? শিশুরা হাসবে, শিশুরা খেলবে ও ছুটাছুটি করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ছুটে চলার পথ কতটুকু সুগম কিংবা কতটুকু সুরক্ষিত প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রিয় পাঠক,আজকে কলম ধরলাম এমন একটি বিষয়ে যা জাতিসংঘের মতে “নীরব মহামারি“।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে,দেশে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে আর পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যায় প্রায় ৩২ জন। এই পরিসংখ্যানটা যদি এভাবে দেখা যায় দেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী যতো শিশু অপঘাতজনিত কারণে প্রতিবছর মারা যায় তার ৪৩ শতাংশেরই মৃত্যু হচ্ছে পানিতে ডুবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বে তিন লাখ ৫৯ হাজার ৪০০ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যান। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১ থেকে ৪ বছর বয়সী শিশুদের এ সংখ্যা প্রায় ১২ হাজার এছাড়াও পানিতে ডোবার কারণে আরো ১৩ হাজার শিশু স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে। আহত হয় আরও এক লাখ শিশু।
ইন্টারন্যাশনাল ড্রাউনিং রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি) বাংলাদেশের ডিরেক্টর ড. আমিনুর রহমান শিশু স্বাস্থ্য, মানসিক বিকাশ এবং অপমৃত্যু রোধে দীর্ঘ দিন থেকে কাজ করছেন। তার মতে, অপঘাতজনিত কারণে আমাদের দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ শিশু মারা যাচ্ছে তার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ পানিতে ডুবে মৃত্যু। সারা বিশ্বের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতেই পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার সব থেকে বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর হার আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারতে। কিন্তু জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে যতজন শিশু পানিতে ডুবে অপমৃত্যু শিকার হচ্ছে তা ভারতের থেকে অনেকাংশে বেশি।
ধারণা করা হয়, নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় শিশু মৃত্যু হার বেশি। কিন্তু আসলে বেশি শিশু মারা যায় পানিতে ডুবে। এটা নিয়ে গণমাধ্যমে বিচ্ছিন্ন আকারে রিপোর্ট আসে কিন্তু তেমন একটা গুরুত্ব পায় না আবার পুলিশের খাতাও এদের সংখ্যা থাকেনা তাই এর ভয়াবহতা অনেকটা সকলের অগচরেই রয়ে যায়।
শিশু নিরাপত্তা এবং অপমৃত্যু রোধে বাংলাদেশে কাজ করছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন পরামর্শক সংস্থা সিনার্গোস। সংস্থাটির পাবলিক অ্যাফেয়ার্স ম্যানেজার ওবায়দুল ফাত্তাহ তানভীর পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রসঙ্গে বলেছেন, আমাদের দেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে অনেক নদী–নালা, খাল–বিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে; যার সিংহভাগই অরক্ষিত। তাই যখনই পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সাধারণ মানুষ এটাকে খুব সহজে এটাকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেয়।
তিনি আরও বলেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার গ্রামাঞ্চলে বেশি। এর বড় একটি কারণ হচ্ছে গ্রামের বাড়ি গুলোর পাশেই পুকুর, ডোবা বা জলাধার থাকতে দেখা যায়। যেগুলোতে কোন ধরনের বেষ্টনী থাকে না। অভিভাবকের সামান্য ৫ থেকে ৭ মিনিটের অসতর্কতা থেকে সদ্য হাটতে শেখা শিশু গুলো খেলতে খেলতে একটা সময় জলাধারগুলোর কাছাকাছি চলে আসে, আর ঘটে দুর্ঘটনা। আর এ দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে। এ সময়টুকু যদি অভিভাবকরা সতর্ক থাকেন তাহলে ৮০ শতাংশ মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
চিত্রটা যখন এমন বেদনাদায়ক, তখন আমরা আমাদের শিশুদের সুরক্ষায় কতটুকু সচেতন? এমন প্রশ্নের জবাবটা যেমন হতাশা জাগানোর, ঠিক এর বিপরীতে সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীদের সাম্প্রতিক পদক্ষেপও আশা জাগায়। গত ২৮ এপ্রিল ২০২১ পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধ বিষয়ক ঐতিহাসিক এক রেজুলেশন সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করল জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে গৃহীত এই রেজুলেশনটি উত্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। রেজুলেশনটিতে পানিতে ডুবে মৃত্যুকে একটি ‘নীরব মহামারি’ হিসেবে হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের ৭৫ বছরের ইতিহাসে এধরণের রেজুলেশন এটাই প্রথম।
নীরব এই বৈশ্বিক মহামারির বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন গত ২০১৮ সালে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বাংলাদেশের পাশাপাশি রেজুলেশনটিতে সহ–নেতৃত্ব দেয় আয়ারল্যান্ড আর এতে সহ–পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে ৮১ টি দেশ। পানিতে ডুবে মৃত্যু বিশ্বের প্রতিটি জাতিকেই ক্ষতিগ্রস্থ করছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে রেজুলেশনটিতে। পাশাপাশি অগ্রহণযোগ্য উচ্চহারের এই মৃত্যু প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনার্থে একটি কর্ম–কাঠামোও প্রদান করা হয়েছে।
রেজুলেশনটিতে আরও বলা হয়েছে, পানিতে ডুবে–মৃত্যুর মতো প্রতিরোধযোগ্য কারণেও বিভিন্ন দেশে শিশু ও কিশোর–কিশোরীগণ অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। পানিতে ডুবে–মৃত্যু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, জাতীয় পদক্ষেপকে উৎসাহিত করা এবং এ বিষয়ক সর্বোত্তম অনুশীলন ও সমাধানসমূহ পারষ্পরিকভাবে ভাগ করে নেওয়ার লক্ষ্যে ২৫ জুলাইকে ‘বিশ্ব ডুবে–মৃত্যু প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ পরিষদ।
হাওর, বিল ও নদ – নদীর দেশ বাংলাদেশ। এখানকার অধিবাসীদের খরস্রোতা নদী কিংবা বন্যার অথৈ পানির বিশালাকার ঢেউয়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে হয়। ভৌগোলিক কারণে এদেশে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার বেশি। তবে এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতা, সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ ও জাতিসংঘের ঘোষিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমবে বৈকি। আর এটি করতে পারলে এসডিজি’র লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে।
সরকার, দেশের জনগন ও জাতিসংঘের সমন্বিত প্রচেষ্টায় শিশু মৃত্যু রোধে কাঙ্খিত সফলতা আসবে। এই হোক মোদের প্রত্যাশা।