বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র
নিজস্ব প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার দুপুর ০৩:৫৮, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২
পাঠ্যক্রমের শিক্ষা হলো সামগ্রিকভাবে মানব মনের একটি আচরণগত পরিবর্তন। শিক্ষা হলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে শেখার সুবিধা বা জ্ঞান, দক্ষতা, মান, বিশ্বাস এবং অভ্যাস অর্জন করা যায়। কারও মতে- শিক্ষা হচ্ছে বৃদ্ধি ও বিকাশমূলক প্রক্রিয়া। আবার কেউ বলেন শিক্ষা সামাজিক প্রক্রিয়া, শিক্ষা জীবনযাপনের প্রস্তুতি।
সুশিক্ষা হলো স্বাধীন মানুষ তৈরির এক যোগ্য হাতিয়ার। শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। শিক্ষা মূলত:-সামাজিক সেবা। উপযুক্ত শিক্ষাই সত্যিকার মানুষ হওয়ার উপায়। মানুষকে সম্পদে পরিণত করতে হলে মানুষের কর্মক্ষমতার উৎকর্ষ সাধন করা একান্তভাবে দরকার। আর এই উৎকর্ষতা বাড়ে তার কর্মদক্ষতার উন্নয়নের মাধ্যমে। এর মাঝে আবার সুশিক্ষা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যার মাধ্যমে মানুষ অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করতে পারে। আর এভাবেই সব ধরনের বাধা পেরিয়ে উত্তরোত্তর একটি জাতি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে।
পাঠ্যক্রমের বাইরেও আমরা যেভাবে শিখি : সবার থেকে আমরা শিখি। আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যা কিছু আছে সবাই আমাদের বন্ধু। ছোট-বড়, চিকিৎসক, দোকানদার, গাছপালা-সবাই আমাদের জীবনকে শিক্ষা দেয়।
প্রতিদিন আমাদের অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। নতুন নতুন অনেক সম্পর্ক তৈরি হয়। আর সেসব সম্পর্কই আমাদের অজান্তে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। সময় আর যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমরা প্রত্যেকেই এখন ভীষণ ব্যস্ত। নিজের জীবন, নিজের ক্যারিয়ার আর নিজের ভালো থাকার বাইরে অন্যের কথা ভাবার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। শুধু তাই নয় চলার পথে যারা আমাদের সঙ্গী, যারা আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যাহায্য করছে তাদের দিকেও ঘুরে তাকানোর মতো অবসর নেই! কিন্তু কথায় বলে জীবনের মতো বড় শিক্ষক আর কেউ নেই!
হাতে কলমে শেখা : শিশুমনে কৌতূহল থাকে ব্যাপক শেখারও একটা অদম্য ইচ্ছা থাকে। মনে থাকে হাজারো প্রশ্ন। কেন হয়, কখন হয়, কী করে হয়…এক একটা সময় বড়রাও উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন! কিন্তু অবুঝ মন খুঁজে চলে অনেক কিছু। ছোট বয়সে মনের কোনও আঘাত দগদগে হয়ে থাকে সারাটা জীবন! এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়, যা হয়তো সারা জীবনের রসদ। চেষ্টা করলেও ভুলে যাওয়া যায় না। চারাগাছ যেভাবে সার, পানি পেয়ে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে, জীবনও ঠিক একইরকম। সময় আর অভিজ্ঞতা জীবনকে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। ছোটবেলায় যে কাজে বারণ করা হয় সেই কাজের উপরই থাকে চরম আকর্ষণ। জীবনে নানা ক্ষেত্রে আমাদের ভুল হয়। কিন্তু সেই ভুলই পরবর্তীতে শিক্ষকের মতো কাজ করে!
সবার থেকে কিছু না কিছু শিখি : সমাজে সবাই নানাভাবে একে-অপরের থেকে উপকৃত হয়। সবার থেকেই কিছু না কিছু শেখার থাকে। পরিবার, প্রতিবেশী, গাছপালা, পশুপাখি, শিক্ষক, ড্রাইভার, গৃহকর্মী, দোকানদার, চিকিৎসক-তালিকাটা বেশ লম্বা। প্রতিদিন আমাদের অনেক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়, অনেক নতুন সম্পর্ক তৈরি হয় আর সেই সব সম্পর্কই আমাদের অজান্তে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায়। অন্যের ভালো-খারাপ দুটোই আমরা দেখি। বোধ-বুদ্ধি অনুসারে বিবেচনার দায় কিন্তু আমাদের। সমাজের প্রতি প্রতিটা মানুষ দায়বদ্ধ। একে অপরকে উৎসাহ দেওয়া, একে অন্যের অনুপ্রেরণা হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার নামই হলো জীবন। অন্যের কথা শোনাটাও কিন্তু একটা শিক্ষা। টেলিভিশন, সিরিয়াল, সিনেমা, রিয়্যালিটি শো, পার্কে খেলা, বাড়ির পোষ্য, ছবি তোলা, হাউস পার্টি, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়া সবাই আমাদের শিক্ষক। পরিস্থিতি আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ দেয়, আর সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয় জীবন।
পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় শিক্ষক : জীবনটাই একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। কখন কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে তা কেউই জানে না। বরং সেই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে শেখায়। জীবনের পারিপার্শ্বিকতা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে অনেক কথা জানান দেয়। বুঝিয়ে দেয় আমাদের আসল বাস্তবকে। বরং ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে শেখায়, আমি কে, কী আমার অস্তিত্ব। কখনও তার সোজা উত্তর পাওয়া যায়, কখনও না। নিজেদের ক্ষমতা, নিজের আত্মবিশ্বাস,নিজের ইতিবাচকতা, নিজের প্রতিভা এই সব কিছুর উত্তর দেয় সময় এবং জীবন।
মনের কথা থেকে শিক্ষা : মন আমাদের অনেক কথা শোনে। অনেক কথা বোঝে। কোন পরিস্থিতিতে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত, সেটাও কিন্তু ভেতর থেকে আমাদের মনই জানান দেয়। কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে; কী করলে সমস্যার সমাধান হবে; সর্বোপরি মানসিকভাবে আমাদের আগলে রাখে জীবন; আর জীবনলব্ধ এসবই হলো বিস্তর অভিজ্ঞতা। জীবন আমাদের অনেককিছু ভরে দিয়েছে,প্রতি মুহূর্তে শিখিয়ে চলেছে। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার আরেক নাম হল জীবন।
চলমান জীবন থেকে আরও কিছু শিক্ষা : ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই। প্রতি মুহূর্তে একটি একটি করে সেকেন্ড হারিয়ে যাচ্ছে। সেকেন্ড ধরে জীবনকে যথাযথ পরিচালিত করতে পারলেই সাফল্যের শীর্ষে পা রাখা যায়। জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের গল্প প্রত্যেক মানুষের আলাদা। গল্পের রকমফের আলাদা হলেও, সবার জীবনই কিন্তু এগিয়ে চলছে। কেউ ধীরে আবার কেউবা দ্রুত সামনে এগোনোর প্রচেষ্টা চালায়। তাই জীবন থেকেও কিছু বাস্তবশিক্ষা নেওয়া যেতেই পারে–
জীবনে কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। অভিযোগ, অনুযোগ, আবেগ-কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়! সামাজিক সম্পর্কগুলো কখনও একই রকম হয় না। আজ যাকে ভালো লাগছে; আগামীকাল তাকে ভালো না-ও লাগতে পারে। আজ যে প্রশংসা করে, আগামীতে কঠোর সমালোচনা করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই!
নিজের তুলনা নিজেই; কখনও অন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন না। পরিচিতজন বা ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ভালো যেকোনো খবর শুনে হতাশ হবেন না, নিজেকে হেয় করবেন না। সংশ্লিষ্টদের যথাযথ উৎসাহ দেওয়ার মধ্য দিয়ে, ভেতরে ভেতরে নিজের পথটা গুছিয়ে মসৃণ করতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখুন।
জীবন সবসময়ই চলমান এবং সচল। যদি ভেবে থাকেন যেখানে কাজ করছেন, সেখানে আপনাকে ছাড়া অচল, বিষয়টা কিন্তু মোটেও তেমন না। পৃথিবীতে কারও জন্য কিছুই বসে থাকে না। এই কথাটা মনে গেঁথে নিন। আপনি যদি আজ কাজ ছেড়ে দেন তাহলে কর্মস্থলে সাময়িক সমস্যা তৈরি হবে, কিন্তু খুব দ্রুত আপনার উপস্থিতি সবাই ভুলে যাবে। তেমনি আজ আপনি হয়তো বন্ধুমহলে বেশ জনপ্রিয়। আপনাকে ছাড়া কোনো আড্ডাই জমে না। জেনে রাখুন, আপনি না থাকলেও আড্ডার রং কোনো অংশেই মলিন হবে না।
উত্থান-পতন জীবনের চরম সত্য একটা বিষয়। তাই সাফল্য কিংবা ব্যর্থতাই জীবনের সবকিছু না। মানিয়ে নিতে পারাটাই আসল কথা। আর সময়কে উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে বেঁচে থাকার নামই জীবন।
অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করুন। আর্থিক স্বাধীনতা জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য করে। তাই বলে ধার করার অভ্যাস কিংবা ঋণে জড়াবেন না। নিজের যতো অল্প আয়ই হোক, ব্যয় করতে হবে বুঝে-শুনে। নিতান্ত প্রয়োজনের বাইরে জিনিসপত্র কেনার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসুন। এই বিষয়গুলো বোঝা জরুরি- দামি মুঠোফোনে হয়তো আনন্দ আসে, কিন্তু মঞ্চনাটক দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আরও বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। তাই বস্তুগত আনন্দের চেয়ে অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ইত্যাদি জমানোর প্রতি মনোযোগী হোন।
মুঠোফোন বা সামাজিক দুনিয়াই জীবনের সব না। আবার দিনের অনেকটা সময় মুঠোফোনের পেছনে ব্যয় করার ফল কখনও ইতিবাচক হয় না। নিজের দক্ষতাকে বাড়ানোর চেষ্টা করুন। নিজের শখের প্রতি গুরুত্ব দিন।
যতো বড় বিপদ বা দুঃখই আসুক, একসময় মলিন হবেই। প্রেমিককে হারানো, ভালো চাকরির সুযোগ না পাওয়া, পরীক্ষায় ব্যর্থতা-এরকম নানাবিধ শোক জীবনে আসবেই। এটা জীবনের নিয়মের মধ্যেই পড়ে। সব দুঃখই ধীরে ধীরে হালকা হতে থাকে। একসময় সব দুঃখ মানিয়ে নিয়ে সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি।
নিজের চলার পথে নিজেই চলতে হয়। কেউ অংশীদার হবে না। অন্যরা আপনাকে যতো পছন্দই করুক না কেন, দিনশেষে নিজের পথ নিজেকেই অতিক্রম করতে হবে। আমাকে কেউ এগিয়ে নেবে তা ভেবে কখনই বসে থাকা যাবে না। প্রত্যেক মানুষের এগিয়ে চলার গল্প, কষ্টের গল্প সম্পূর্ণ আলাদা।
অন্যের মতামত জীবনের সবকিছু নয়। একই জিনিস কারও কাছে ভালো লাগে, আবার কারও কাছে খারাপ লাগে বা পছন্দ করেন না। ঠিক একইভাবে আমার কাজ কারও কাছে ভালো লাগতেও পারে, আবার নাও ভালো লাগতে পারে। তাই সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে কাজ করুন।
শুধু পরিশ্রমে সবসময় জীবনে সাফল্য নাও আসতে পারে। পরিশ্রমের সঙ্গে যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সৃজনশীলতার দরকার হয়। জীবনকে একঘেয়েমির বৃত্তে আটকে ফেলবেন না। সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ঝুঁকি নিতে শিখুন। ঝুঁকি নেওয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, আমরা জানি না, সামনে কী আসবে। আর অচেনা-অজানা পথই সামনে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়! আমরা চরম উৎফুল্ল হই, জীবন আনন্দময় হয়ে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে!
সবশেষে জীবন থেকে আমরা যে শিক্ষা নিতে পারি তার সারমর্মটা এরকম : আমাদের মন আমাদের সেরা বন্ধু এবং সবচেয়ে খারাপ শত্রু; আমরা কেউই সবজান্তা নই; অতিরিক্ত চিন্তা মানেই দুশ্চিন্তা করা; মনে রাখবেন সবকিছুই অস্থায়ী; রাগের মধ্যে কোনো সুখ নেই; জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো কোনো ঝুঁকি না নেয়া; আপনাকে নিয়ে মানুষের চিন্তা জীবনের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় না; সুখ একটা পছন্দ মাত্র; লোভ কখনও দমন করা যায় না; নিজের ব্যথা অন্য কেউ অনুভব করতে পারে না!