নিজস্ব প্রতিনিধি
মঙ্গলবার দুপুর ০৩:৪৪, ৫ নভেম্বর, ২০১৯
আবু ইউসুফ, নওগাঁ প্রতিনিধি: হঠাৎ করেই বিভিন্ন মাঠের আমন ধান ক্ষেতে কারেন্ট পোকার আক্রমনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা-কৃষাণীরা। আমন মৌসুমের প্রায় শেষ সময়ে এসে ধানের শীষ বের হওয়া ও আধা-পাকা ধানের ক্ষেতেই হঠাৎ করেই আক্রমন কারেন্ট পোকা। ফলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে জমিতে ফলানো আমন ধান রক্ষার জন্য বাজার থেকে বিভিন্ন কোম্পানীর কিটনাশক কিনে ধানের ক্ষেতে স্প্রে করে ধান রক্ষার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কৃষকরা। নওগাঁ জেলায় চলতি আমন ধান চাষ মৌসুমে কৃষি বিভাগের ধার্যকৃত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত ২৯ হাজার ৮২৩ হেক্টর বেশী জমিতে বেশী আমন ধান চাষ করেছেন জেলার কৃষকরা।
এমনকি নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সহ জেলার সাধারন কৃষক ও কৃষাণীরা ও এক সপ্তাহ পূর্বে হাঁসি মুখেই বলেছিলেন এবার নওগাঁয় ধানের বাম্পার ফলন হবে এবং বাজারে যদি নায্য (ধানের দাম ভালো) থাকে সেক্ষেত্রে বিগত বছর গুলোতে যে লোকসান হয়েছে তা পুশিয়ে নিয়ে লাভের মুখ দেখবেন কৃষক-কৃষাণীরা। অথচ সপ্তাহর ব্যবধানে হঠাৎ করেই জেলার বিভিন্ন মাঠের আমন ধানের ক্ষেতে কারেন্ট পোকা আক্রমন করায় ইতিমধ্যেই কৃষক-কৃষাণীর সেই হাঁসিমুখ এখন মলীন হয়ে পড়েছে।
এব্যাপারে সরজমিনে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মাঠে আমন ধান ক্ষেতে গিয়ে দেখা যায় সদ্যবের হওয়া ও আধাপাকা ধানের শীষ হালকা বাতাসেই দোলখাচ্ছে, আর প্রায় জমিতেই বিভিন্ন জায়গাঁয় মরা ধানের গাছ লক্ষ্য করা গেছে। বাগধানা গ্রামের কৃষক শ্রী-সমরাজ মন্ডল বলেন, আমার আড়াই বিঘা জমির ধান পেকে গেছে বল্লেই চলে, সেই ধানে হঠাৎ করেই কারেন্ট পোকা আক্রমন করার কারনে আমি সাথে সাথে বাজারের একটি থেকে দোকানীর পরামর্শে কিটনাশক এনে স্প্রে করেছি তারপর ও কারেন্ট পোকার আক্রমন থেকে আমার ধানের ক্ষেত রক্ষা করতে পারিনি, জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মাত্র দুদিনের ব্যবধানে ধান ক্ষেত মড়ে যাওয়ার দৃশ্যদেখে ঠিক থাকতে না পেরে ফের অপর একটি দোকানীর কাছে থেকে আলাদা কোম্পানীর কিটনাশক এনে আজ স্প্রে করছি। কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠে দু জন কিটনাশক স্প্রে করছেন দেখে এগিয়ে গেলে তারা ও একই সুরে বলেন, কিটনাশক স্প্রে করেও কারেন্ট পোকা শতভাগ দমন করা সম্ভব হচ্ছেনা, তবে আজ স্প্রে করছি এতে করে হয়তবা ২/৩ দিন কিছুটা আক্রমন কম থাকবে জানিয়ে তারা আরো বলেন, যে কিটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে সেটা বলতে পারেন যে মনকে বুঝ দেয়ার জন্যই স্প্রে করা হচ্ছে। কারন, ৩ দিন পূর্বেই এ জমিতে স্প্রে করার পর ও ফের ব্যাপক হারে আবারো কারেন্ট পোকা আক্রমন করেছে বলেই আজ ফের কিটনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। এসময় প্রতিবেদককে ধান গাছের গোড়ালীতে ছোট আকারের পোকা দেখিয়ে বলেন এগুলোই হলো সেই কারেন্ট পোকা। একারেন্ট পোকা ধান গাছের রস চুষে খেয়ে নেয়ার কারনেই ধানের গাছ প্রতিনিয়তই জমিতেই মরে যাচ্ছে বলেও তারা জানিয়েছেন।
চৌমাশিয়া গ্রামের সাজ্জাদ হোসেন মন্ডল, শাহ-আলম মন্ডল সহ বেশ কয়েকজন কৃষক ও একই সুরে বলেন, আসলে বাজারের কিটনাশক গুলোই ভেযাল কিনা। কারন কিটনাশক স্প্রে করার পরও কারেন্ট পোকা দমন হচ্ছে না, ১/২ দিনের ব্যবধানে আবারো আক্রমন করছে কারেন্ট পোকা। তারা আরো বলেন, যে কৃষকরা নিয়মিত কিটনাশক স্প্রে করছেন তাদের ধান ভালোভাবে মাঠ থেকে উঠলেও চলতী মৌসুমে সব কৃষকের ফলানো আমন ধান এবার ভালোভাবে মাঠ থেকে বাড়িতে তুলতে পারবেন না কারেন্ট পোকার আক্রমনের কারনে।
কারেন্ট পোকার আক্রমনে শিকার ধান জমি
প্রতিবেদককে একজন কৃষক চৌমাশিয়া নওহাটামোড় বাজারের পরিত্যাক্ত সাবেক পল্লী সিনেমা হলের পেছনে রোপনকৃত চিনি আতব ধানের ক্ষেতে নিয়ে যান। গিয়ে যা দেখা গেলো তাতে এমন কেউ নেই যে এ জমির ধান ক্ষেত দেখে হতবাক না হয়ে থাকতে পারবেন। কারন, মাত্র ১২ বা ১৩ কাঠা জমিতে রোপনকৃত চিনি আতব ধানের শীষ সদ্যবের হয়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু এতোটুকু জমিতেই ৮/৯ স্থানে কারেন্ট পোকা ব্যাপক আক্রমন করে প্রতিটি স্থানে ৩/৪ হাত পরিমান করে ধানের গাছ ইতি মধ্যেই মড়ে গেছে। এজমিতে একবার কারেন্ট পোকা দমনের জন্য কিটনাশক স্প্রে করেও কোন লাভ হয়নি বলেই জানিয়েছেন কৃষক। আমন মৌসুমের শেষ মহূর্তে এসে হঠাৎ করে কারেন্ট পোকা আক্রমন করার কারনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা।
তারপর ও কৃষক-কৃষাণী সহ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর এর কর্মকর্তারা বলছেন, যেহতু চলতি মৌসুমে প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর বেশী জমিতে নওগাঁয় আমন ধান চাষ করা হয়েছে জানিয়ে বলেন, শুধুমাত্র কারেন্ট পোকা দমন করতে পারলেই নওগাঁয় এখনো ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাজারে ধানের মূল্য বারানো হলে কৃষকরা কিছুটা হলেও লোকসানের মুখ থেকে রক্ষা পাব বলে দাবি করেন কৃষকরা।
উল্লেখ্য যে- চলতি আমন মৌসুমে নওগাঁ জেলায় ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৬ হেক্টর জমিতে। কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা ছারিয়ে নওগাঁর ১১টি উপজেলায় এ বছর কৃষকরা আমন ধান চাষ করেছেন ১ লাখ ৯৭ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে।
নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সিরাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, চাষকৃত ধানের মধ্যে উন্নত ফলনশীল উফশী জাতের ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৬১ হেক্টর, স্থানীয় জাতের ২৮ হাজার ৯৮৮ হেক্টর এবং হাইব্রীড জাতের ১৩০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ করেছেন জেলার কৃষকরা। কৃষকরা এ বছর উফশী জাতের মধ্যে স্বর্না, ব্রী-ধান-৩৪, ব্রী-ধান-৪৯, ব্রী-ধান-৫১, ব্রী-ধান-৫২, বিনা-৭, রঞ্জিত এবং পাইজাম উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় জাতের মধ্যে রয়েছে, চিনি আতপ ও বিন্না ফুল ধান উল্লেখযোগ্য।
নওগাঁ জেলায় উপজেলা ভিত্তিক আমন ধান চাষের পরিমান হচ্ছে, নওগাঁ সদর উপজেলায় উফশী জাতের ৮ হাজার ৬৯০ হেক্টর, স্থানীয় জাতের ৯৭৫ হেক্টর ও হাইব্রীড জাতের ৭০ হেক্টর, রানীনগর উপজেলায় উফশী জাতের ১৭ হাজার ৮৮০ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২৪৫ হেক্টর, আত্রাই উপজেলায় উফশী জাতের ৩ হাজ্রা হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২ হাজার ১২৫ হেক্টর, বদলগাছি উপজেলায় উফশী জাতের ১২ হাজার ৩০০হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ১ হাজার ৫০০ হেক্টর, মহাদেবপুর উপজেলায় উফশী জাতের ১৮ হাজার ৪০ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ১০ হাজার ৩০০ হেক্টর, পত্নীতলা উপজেলায় উফশী জাতের ২৫ হাজার ১০০ হেক্টর, স্থানীয় জাতের ৩ হাজার হেক্টর ও হাইব্রীড জাতের ১০ হেক্টর, ধামইরহাট উপজেলায় উফশী জাতের ১৯ হাজার ৪৩ হেক্টর, স্থানীয় জাতের ৬৬৩ হেক্টর ও হাইব্রীড জাতের ৫০ হেক্টর, সাপাহার উপজেলায় উফশী জাতের ১০ হাজার ১০ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২ হাজার ৫০ হেক্টর, পোরশা উপজেলায় উপশী জাতের ১৫ হাজার ৪৮২ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ১ হাজার ২৭০ হেক্টর, মান্দা উপজেলায় উফশী জাতের ১৩ হাজার ৩১০ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ২ হাজার ৪৬০ হেক্টর এবং নিয়ামতপুর উপজেলায় উফশী জাতের ২৫ হাজার ৩০৬ হেক্টর ও স্থানীয় জাতের ৪ হাজার ৪০০ হেক্টর। তবে শেষ পর্যন্ত ধান (কাটা-মাড়াই) এর সময় পর্যন্ত আবহাওয়া যদি অনকূলে থাকে সেক্ষেত্রে চলতি মৌসুমে নওগাঁ জেলায় আমন ধানের বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষি বিভাগ সহ জেলার কৃষকরা।
একই সাথে অভিযোগের সুরে কৃষকরা বলেন, বিগত ধানের মৌসুম গুলোতে লাগাতারভাবে ধানের নায্য দাম (মূল্য) না পাওয়ায় আমাদের অনেক লোকসানের মুখে পড়তে হয়েছে জানিয়ে চলতি মৌসুমে কৃষকদের রক্ষা করতে প্রতি মন ধানের মূল্য ৯ শত থেকে সারে ৯ শত টাকার নিচে যেন কেনাবেচা কৃষকদের করতে না হয় সে ব্যাপারে জেলার হাট-বাজার গুলোতে নজরদারী করা সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ও সরকারের প্রতি আশুদৃষ্টি কামনা করেছেন জেলার হতাশগ্রস্থ্য কৃষকরা।
কৃষকরা আরো বলছেন, বাজারে যদি বিগত মৌসুমের ন্যায় এবারেও ধানের মূল্য কম হয় সেক্ষেত্রে বাম্পার ফলনে ও কৃষকদের গলায় ফাঁস পড়বে বলেই মন্তব্য প্রকাশ করছেন কৃষকরা।