ফেতনা কি এবং তার আলামত কি কি! -হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী
মেঘনা নিউজ ডেস্ক সোমবার দুপুর ০১:৪৩, ২১ অক্টোবর, ২০২৪
আল্লাহ তায়ালা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দুনিয়ায় শেষ নবীরূপে প্রেরণ করেছেন। তাঁর ওপর নবুওয়াতের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি ঘটেছে। পূর্ববর্তী নবীদের ওপর তাঁর বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব হলো, পূর্ববর্তী নবীদেরকে বিশেষ সম্প্রদায় কিংবা বিশেষ এলাকার জন্য এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। তাদের শিক্ষা ও দাওয়াত একটি নির্ধারিত সময়কাল পর্যন্ত এবং একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন, হজরত মুসা (আ.)-কে মিসর অঞ্চলে বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের নবীরূপে পাঠানো হয়েছে। বনী ইসরাইল সম্প্রদায় এবং মিসর অঞ্চলে তার নবুওয়াত এবং রিসালাত সীমাবদ্ধ ছিল। পক্ষান্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তায়ালা বিশেষ কোনো সম্প্রদায়, বিশেষ কোনো জাতি কিংবা বিশেষ কোনো অঞ্চলের জন্য এবং নির্ধারিত সময়ের জন্য নবীরূপে প্রেরণ করেননি। বরং পুরা পৃথিবীর জন্য, সব মানুষ ও জিনের জন্য এবং কেয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য নবী বানিয়েছেন। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
‘হে নবী, আমি আপনাকে সব মানুষের জন্য সুসংবাদদাতা এবং সর্তককারীরূপে প্রেরণ করেছি। (সূরা: সাবা, আয়াত: ২৮)।
এ থেকে বুঝা যায়, তাঁর রিসালাত ও নবুওয়াত আরবভূমিতে সীমাবদ্ধ নয় এবং বিশেষ কোনো যুগের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। বরং কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব যুগের জন্য তাঁকে রাসূল বানানো হয়েছে।
ভবিষ্যতে সঙ্ঘটিত অবস্থাসমূহের বর্ণনা:
অতএব, তাঁর শিক্ষা ও তাঁর বর্ণিত বিধি-বিধান কেয়ামত পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। কোনো যুগের সঙ্গে তাঁর শিক্ষা সীমাবদ্ধ নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে শিক্ষা দান করেছেন তা জীবনের সব শাখায় পরিব্যাপ্ত। তাঁর শিক্ষার দুটি দিক আছে। একটি হলো, শরীয়তের বিধি-বিধানের বর্ণনা। যেমন, অমুক জিনিস হালাল এবং অমুক জিনিস হারাম, এ কাজ জায়েজ এবং ওই কাজটি নাজায়েজ, অমুক আমলটি ওয়াজিব, অমুক আমলটি সুন্নত এবং অমুক আমলটি মুসতাহাব। অন্যটি হলো, মুসলিম উম্মাহ ভবিষ্যতে কি ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হবে এবং তাদের ওপরে কি কি বিপর্যয় আসবে এবং সে অবস্থায় করণীয় কি, তার বর্ণনা।
এ দ্বিতীয় দিকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিনি ভবিষ্যতে সঙ্ঘটিত ঘটনাবলী সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত হওয়ার পর উম্মতকে জানিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে এই এই ঘটনা ঘটবে এবং সে অবস্থায় উম্মতের করণীয় কি তাও বলে দিয়েছেন।
উম্মতের নাজাতের ফিকির:
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের নাজাতের চিন্তায় সর্বদা ব্যাকুল থাকতেন। এক হাদিসে আছে,
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা চিন্তান্বিত এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত থাকতেন। মনে হত সর্বদাই তাঁর ওপর কোনো দুঃখ ছেয়ে আছে। এটা কিসের দুঃখ? যে সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছে তাদেরকে কীভাবে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানো যায়, কীভাবে তাদেরকে ভ্রান্ত পথ থেকে সত্য-সুন্দর পথে নিয়ে আসা যায়, এটাই ছিল তাঁর চিন্তা ও দুঃখের একমাত্র কারণ। কোরআনুল কারিমে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করেই ইরশাদ হয়েছে,
‘লোকেরা ঈমান আনছে না বলে আপনি কি দুঃখে আত্মবিনাশী হয়ে পড়বেন? (সূরা: শুয়ারা, আয়াত: ৩)।
এক হাদিসে আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমার উম্মাহ হলো এক ব্যক্তির ন্যায়, যে আগুন প্রজ্বলিত করল এবং তা দেখে পতঙ্গসমূহ উড়ে এসে আগুনে পড়তে লাগল। লোকটি পতঙ্গগুলোকে দূরে রাখার চেষ্টা করে কিন্তু তারপরও সেগুলো আগুনে ঝাপ দেয়। এমনিভাবে আমিও তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি, তোমাদের কোমর ধরে ধরে বাঁধা দিচ্ছি কিন্তু এর পরও তোমরা জাহান্নামের আগুনে পড়ে যাচ্ছ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুধু তাঁর যুগের লোকদের জন্য ফিকির ছিল তাই নয় বরং কেয়ামত পর্যন্ত আগত সব উম্মতের জন্য সমান ফিকির ছিল।
ভবিষ্যতে কি কি ফেতনা দেখা দেবে? তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগত লোকদেরকে সমকালীন অবস্থা সম্পর্কে সর্তক করেছেন। এ সম্পর্কিত হাদিসগুলো হাদিসের প্রায় সব গ্রন্থেই ‘কিতাবুল ফিতান’ নামে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
‘ভবিষ্যতে তোমাদের গৃহে বৃষ্টির ফোঁটার ন্যায় ক্রমাগত ফেতনা দেখা দেবে। বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে আগত ফেতনাকে তুলনা করে দুইটি বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এক. বৃষ্টিতে পানির পরিমাণ যেরূপ অনেক থাকে তদ্রুপ ভবিষ্যতে ফেতনার পরিমাণও হবে অনেক। দুই. বৃষ্টির ফোঁটা যেরূপ ক্রমাগত ও বিরামহীন পড়ে, ফেতনাও তদ্রুপ ক্রমাগত ও বিরামহীন আসবে। একটি ফেতনা শেষ না হতেই আরেকটি ফেতনা দেখা দেবে। দ্বিতীয়টি শেষ না হতেই তৃতীয়টি দেখা দেবে এবং এ ফেতনাগুলোর প্রভাব তোমাদের ঘরে এসে পড়বে। অন্য এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
অচিরেই আঁধার রাতের অন্ধকারচ্ছন্নতার মতো ফেতনা দেখা দেবে। অর্থাৎ অন্ধকার রাতে যেরূপ মানুষ রাস্তা খুঁজে পায় না, তদ্রুপ ফেতনার যুগে মানুষ কি করবে তা বুঝে উঠতে পারবে না। ফেতনা তোমাদের পুরা সমাজ ও পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। তা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো পথ তোমাদের দৃষ্টিগোচর হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ ফেতনা থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়ার দোয়া শিখিয়েছেন,
হে আল্লাহ, আমরা আগত ফেতনাসমূহ থেকে আপনার কাছে পানাহ চাই। যাহেরি ফেতনা থেকেও পানাহ চাই এবং বাতেনি ফেতনা থেকেও পানাহ চাই। এ দোয়াটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিয়মিত দোয়াসমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ফেতনা কি?
ফেতনা কি জিনিস? ফেতনা কাকে বলে? ফেতনার যুগে আমাদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা কি? ফেতনা শব্দটি কোরআনুল কারিমে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হয়েছে। সূরা বাকারায় ইরশাদ হয়েছে,
আল্লাহর কাছে ফেতনা হত্যা অপেক্ষা মারাত্মক।
ফেতনার অর্থ ও মর্ম:
ফেতনা আরবি শব্দ। অভিধানে এর অর্থ হলো, আগুনে গলিয়ে স্বর্ণ বা রূপার খাঁদ পরখ করা। পরবর্তীতে শব্দটিকে পরখ করা, যাচাই করা, পরীক্ষা করা ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়। সুতরাং ফেতনার অন্য অর্থ হলো, পরখ করা ও পরীক্ষা করা। যখন মানুষ বিপদ-মসিবতে আক্রান্ত হয় কিংবা দুঃখ-বেদনার শিকার হয় তখন তার ভেতরগত অবস্থার একটি পরীক্ষা হয় যে, এরূপ অবস্থায় সে কী কর্মপন্থা অবলম্বন করে? সে কি ধৈর্য ধারণ করে, না ধৈর্যহারা হয়ে পড়ে? আল্লাহ তায়ালার অনুগত থাকে, না অবাধ্য হয়ে পড়ে? এ পরীক্ষাকেও ফেতনা বলা হয়।
হাদিস শরিফে ফেতনা শব্দের ব্যবহার:
হাদিস শরিফে শব্দটি যে অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে তা হলো, যখন এরূপ পরিস্থিতি দেখা দেয় যে, সত্যকে চেনা যায় না, হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য করা মুশকিল হয়, সঠিক এবং ভুলের মাঝে পার্থক্য বাকি থাকে না, সত্য কোনটি এবং মিথ্যা কোনটি তা বুঝা যায় না, এরূপ পরিস্থিতিতে বলা এটি ফেতনার যুগ। এমনিভাবে যখন সমাজে পাপাচার, গুনাহ ও অশ্লীলতা ব্যাপকরূপ লাভ করে একেও ফেতনা বলা হয়। এমনিভাবে না হককে, হক মনে করা এবং প্রমাণহীন জিনিসকে প্রমাণিত মনে করা একটি ফেতনা। যেমন, বর্তমান যুগে দেখা যায়, কাউকে কোনো দ্বীনি বিষয়ে বলা হলো যে, এ কাজটি গুনাহ, নাজায়েজ বা বেদআত। উত্তরে সে বলে, আরে, এ কাজ তো সবাই করছে, যদি এটা গুনাহ বা নাজায়েজ হয় তাহলে সারা দুনিয়ার লোক এটা কেন করছে? এ কাজ তো সৌদি আরবেও হচ্ছে…।
আজকের যুগে এটি একটি নতুন দলিল আবিষ্কৃত হয়েছে যে, আমরা সৌদি আরবে এ কাজ করতে দেখেছি। এর দ্বারা বুঝা যায়, সৌদি আরবে যেই কাজ হয় তা নিঃসন্দেহে সঠিক এবং বৈধ। অতএব, যে জিনিস দলিল ছিল না তাকে দলিল মনে করাও একটি ফেতনা।
দুই দলের লড়াই একটি ফেতনা:
এমনিভাবে যখন দু’জন মুসলমান কিংবা মুসলমানদের দুটি দল পরস্পর লড়াই করে এবং একে অন্যকে হত্যা করতে উদ্যত হয় এবং জানা যায় না, কে ন্যায়ের ওপর এবং কে অন্যায়ের ওপর আছে, তা হলে এটিও একটি ফেতনা। এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যদি দুজন মুসলমান তরবারি নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে তা হলে হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই জাহান্নামে যাবে। এক সাহাবি জিজ্ঞাসা করেন, হে আল্লাহর রাসূল, হত্যাকারী জাহান্নামে যাবে, এটা তো ঠিক আছে; সে একজন মুসলমানকে হত্যা করেছে কিন্তু নিহত ব্যক্তি কেন জাহান্নামে যাবে? উত্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কারণ সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার জন্য তরবারি উত্তোলন করেছিল। যদি কৌশলে সে পরাজিত না হত তাহলে সেই তার সঙ্গীকে হত্…
কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলাম এবং মুসলমানের পরিচয়। হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।
ইসলাম কী : ইসলাম শব্দের অর্থ- আত্মসমর্পণ করা। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গরূপে কোরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য আত্মা তথা মনকে সমর্পণ করা। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ধর্ম মানেই ইসলাম। অন্য কোনো ধর্মের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা অসম্ভব। এরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহর কাছে মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯)।
ইসলামের উপমা: ইসলাম হলো একটি তাবুর ন্যায়। তাবু যেমন তার ভেতরের মানুষকে রোদের সময় রোদ, শীতের সময় ঠান্ডা, প্রচন্ড বাতাসের সময় ধুলোবালি থেকে রক্ষা করে, তদ্রুপ ইসলাম মানুষকে পরকালীন আজাব থেকে রক্ষা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, তারাই প্রকৃত মুসলমান। এরশাদ হচ্ছে-‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)। এ আয়াতে প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তিকে ইমান আনার পর ইসলামের বিধান তথা কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় শুধু মুমিন তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে প্রকৃত মুসলমান বলা যাবে না।
প্রকৃত মুসলমানের দৃষ্টান্ত: প্রকৃত মুসলমানের দৃষ্টান্ত হলো- একটি দেয়ালঘড়ির ন্যায়। যার সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিটের কাঁটা এবং ঘণ্টার কাঁটা আছে। ব্যাটারিতে আছে পূর্ণ চার্জ। বেতারকেন্দ্রের সময়ের সঙ্গে এর সময়ের মিল রয়েছে। এ ধরনের ঘড়ির সময় দেখে কেউ যদি কোনো মিটিংয়ে যোগ দিতে চায়, তাহলে সে প্রস্ততি নিয়ে ঠিক সময়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারবে। ইমানও তেমনই বিষয়। ইমান গ্রহণ করার পর ঘণ্টার কাঁটার মতো ফরজ, মিনিটের কাঁটার মতো ওয়াজিব এবং সেকেন্ডের কাঁটার মতো সুন্নতের অনুসরণ করতে হবে। জীবনের কোনো অবস্থাতেই ফরজ-ওয়াজিব বাদ দেওয়া যাবে না। ঘণ্টা কিংবা মিনিটের কাঁটা যদি কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়, তাহলে ঘড়ি যেমন সঠিক সময় নির্ণয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি ফরজ বা ওয়াজিব যদি ছুটে যায়, তাহলে ইমানও ব্যক্তিকে পূর্ণ ইমানদার বানাতে পারবে না। ঘড়ির ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে যেমন পুনরায় সচল করার জন্য নতুন ব্যাটারি লাগাতে হয়, তদ্রুপ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষের মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়। সেজন্য মাঝেমধ্যে আল্লাহর অলিদের মজলিসে অথবা ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে মনের ব্যাটারিতে চার্জ দিয়ে ইমান তরতাজা করতে হয়। পাশাপাশি ধর্মীয় বই পাঠের অভ্যাস করে নিতে হয়। তাহলেই প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়, আখেরাতের প্রস্ততি নেওয়া সম্ভবপর হয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সন্তষ্টি অর্জন করে হাজির হওয়া যায় আল্লাহর দরবারে।
নামধারী মুসলমানের পরিচয়: যারা ইসলামের কিছু বিধান পালন করে আর কিছু পালন করে না, যেমন- নামাজ পড়ে, তবে নিয়মিত পড়ে না; রোজা রাখে, সবগুলো রাখে না; অন্যান্য আমলের বেলায়ও কিছু করে, কিছু করে না; আবার করলেও নিয়মিত করে না- এদের দৃষ্টান্ত হলো, তারা এমন দেয়ালঘড়ির ন্যায়, যার সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিটের কাঁটা, ঘণ্টার কাঁটা আছে, কিন্তু ঘড়ির সময়ের সঙ্গে বেতারকেন্দ্রের সময়ের কোনো মিল নেই। এমন ঘড়ি দূর থেকে ঘড়ি মনে হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না এর দ্বারা। এ ধরনের ঘড়ির সময় দেখে কোনো কাজ করলে বিভ্রান্তির স্বীকার হতে হয়। তদ্রুপ যে ব্যক্তি ইসলামের সকল বিধান মানে না, সে দূর থেকে দর্শকের দৃষ্টিতে মুসলমান; কিস্তু ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত মুসলমান নয়।
প্রকৃত মুসলমানের গুণাবলি: কোরআনে কারিমের বিভিন্ন স্থানে মহান রাব্বুল আলামিন প্রকৃত মুসলমানের বেশ কয়েকটি গুণ বর্ণনা করেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে-‘যাদের সামনে আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর ভীত হয়, যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করে, যারা নামাজ কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ : ৩৫)। এ ছাড়াও সুরা মুমিনুনের প্রাথমিক আয়াতগুলোতে আল্লাহতায়ালা প্রকৃত মুসলমানের গুণ এভাবে বর্ণনা করেছেন-‘যারা নিজেদের নামাজে নম্র, যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা জাকাত প্রদান করে।’ (সুরা মুমিনুন : ২-৪)।
মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যাবতীয় কাজ-কর্মে আল্লাহর হুকুম-আহকাম মেনে চলাই হচ্ছে মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর তাঁর হুকুম-আহকাম পালনের আমলই হলো ইবাদত। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। দুনিয়াতে মানুষের আগমন ও জীবনের লক্ষ্য হলো, আল্লাহতায়ালার বিধিবিধানের বাস্তবায়ন তথা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করা। এরশাদ হচ্ছে-‘আর জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আগমনের কারণে যে প্রক্রিয়ায় ইবাদত তথা সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হবে, তা হলো- প্রথমত আল্লাহতায়ালাকে রব হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর দাসত্ব স্বীকার করা। এরপর তাঁর নির্দেশ মেনে তাঁরই পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। তারপর সর্ববিষয়ে তাঁর সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা অর্থাৎ আল্লাহতায়ালাকে রব বলে স্বীকার করা, অন্য কাউকে তাঁর সঙ্গে শরিক না করা।
ইবাদত কী : আরবি ‘ইবাদত’ শব্দটি ‘আব্দ’ শব্দ হতে এসেছে। ‘আব্দ’ শব্দের অর্থ হলো দাস বা গোলাম। সুতরাং ইবাদত মানে হলো আল্লাহর গোলামি বা বন্দেগি করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথ ও মতে জীবন পরিচালনা করা। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি আল্লাহর গোলামি করবে, সে-ই প্রকৃত সফলকাম। মানুষ যখন কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ পালন করে ইবাদত করতে ব্যর্থ হয়, বুঝতে হবে আল্লাহর বান্দা হিসেবে দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্যই তখন ব্যর্থ। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্ক গভীর হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন-‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করো, আমি তোমার হৃদয়কে অভাবমুক্ত করে দেবো এবং দারিদ্র বিমোচন করে দেবো। আর যদি তা না করো, তাহলে কর্মব্যস্ততা দ্বারা তোমার হাত ভরে দেবো। দারিদ্রও দূর করবো না।’ (আল মুসনাদ : ১৬/২৮৪)। মোল্লা আলি কারি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-‘এর অর্থ হলো, তুমি তোমার রবের ইবাদত করার সময় মন-দিল উপস্থিত রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকো।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৭/২৬)।
ইবাদত সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা: মানুষ মনে করে- কোরআনে কারিমের নির্দেশ পালনে নামাজ আদায় করা, রোজা ও হজ পালন করা, জাকাত দেওয়া, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করার নামই ইবাদত। না, ইবাদত মানে তা নয়। মিথ্যা কথা বলে, সুদ-ঘুষে জড়িত থেকে, লোক দেখানো ইবাদত করে, বেহায়াপনা, চোগলখুরি, হিংসা-বিদ্বেষ ও মুনাফেকির সঙ্গে লিপ্ত থেকে কেবল নামাজ-রোজার মতো অন্যান্য আমল করার নাম ইবাদত নয়। কোরআন-সুন্নাহর নিষেধগুলো মেনে রাব্বে কারিমের যাবতীয় আদেশ পালন করা হলো প্রকৃত ইবাদত তথা বন্দেগি। কারণ ইবাদত হলো আল্লাহতায়ালার হুকুম-আহকাম যথাযথ পালন করা।
এরশাদ হচ্ছে-‘আর রাসুল তোমাদেরকে যা দেন (নিয়ে এসেছেন), তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা হাশর : ৭)। তাই আমাদেরকে আত্মপরিচয় সম্বন্ধে অবগত হতে হবে। এরপর নিজেদের সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ইবাদত করার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনোক্রমেই যেনো আমাদের কোনো আমল লোকদেখানোর জন্য না হয়; বরং একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিলই যেনো হয় আমাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য-মাকসাদ। রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে কবুল করে নিন। আমিন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।