করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ৫০ জনের মরদেহ উদ্ধার
নিজস্ব প্রতিনিধি মঙ্গলবার রাত ০২:২৭, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২
পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর আউলিয়াঘাটে নৌকাডুবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়েছে। সোমবার ২৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে দুদিনে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫০ জনে।
পঞ্চগড় জেলার করতোয়া নদী ও দিনাজপুর জেলার আত্রাই নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে সোমবার সারা দিনে ২৫টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর নিখোঁজের সংখ্যা ৪০ জনে নেমে এসেছে। জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে স্থাপিত জরুরি তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় রাতে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে এ তথ্য দিয়েছেন। এ সময় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
মঙ্গলবার আবারও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা হবে বলেও জানিয়েছেন দীপঙ্কর রায়। দ্বিতীয় দিন পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের মধ্যে ২৫ জন নারী, ১৩ জন শিশু ও ১২ জন পুরুষ রয়েছে। স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতায় ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদলের সদস্যরা এসব মৃতদেহ উদ্ধার করেছেন। এদের মধ্যে সাতজনের মৃতদেহ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়।
উদ্ধারকৃত ব্যক্তিরা হলেন-হাতেম আলী (৭০), শ্যামলী রানি (১৪), লক্ষ্মী রানি (২৫), অমল চন্দ্র (৩৫), শোভা রানি (২৭), দীপঙ্কর (৩), পিয়ন্ত (৩), রুপালি ওরফে খুকি রানি (৩৫), প্রমিলা রানি (৫৫), অনবালা (৬০), সুনিতা রানি (৬০), ফাল্গুনী (৪৫) প্রমিলা দেবী (৭০), জ্যোতিশ চন্দ্র (৫৫), তারা রানি (২৫), বিষ্ণু (৩), সফলতা রানি (৪০), বিলাশ চন্দ্র (৪৫), শ্যামলী রানি ওরফে শিমুলি (৩৫), উশোশি (৮), তনুশ্রী (৫), শ্রেয়সী (৮), প্রিয়ন্তী (৮), সনেকা রানি (৬০), ব্রজেন্দ্র নাথ (৫৫), ঝর্ণা রানি (৪৫), দীপ বাবু (১০), সূচিত্রা (২২), কবিতা রানি (৫০), বেজ্যে বালা (৫০), দিপশিখা রানি (১০), সুব্রত (২), জগদীশ (৩৫), জ্যোতির্ময় (১৫), গেন্দা রানি (৫০), কনিকা রানি (৪০), সুমিত্রা রানি (৪৫), আদরী (৫০), পুষ্পা রানি (৫০), প্রতিমা রানি (৫০), সূর্যনাথ বর্মণ (১২), হরিকেশর বর্মণ (৪৫), নিখিল চন্দ্র (৬০), সুশীল চন্দ্র (৬৫), যূথী রানি (১), রাজমোহন অধিকারী (৬৫), রুপালি রানি (৩৮), প্রদীপ রায় (৩০), পারুল রানি (৩২) ও প্রতিমা রানি (৩৯)। এদের মধ্যে প্রথম দিনের উদ্ধার অভিযানের ২৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল।
কন্ট্রোল রুম, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় এলাকাবাসী জানায়, রাজশাহী, রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে আসা ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিদল সোমবার সকাল ৬টায় দ্বিতীয় দিনের উদ্ধার অভিযান শুরু করে। নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজে বের করতে ভোর থেকেই করতোয়ার দুপাড়ে মানুষ আসতে শুরু করে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকায় মানুষের ঢল নামে।
ডুবুরি দলের উদ্ধার অভিযানে আধুনিক যন্ত্রপাতির স্বল্পতায় স্থানীয় মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। একপর্যায়ে নিখোঁজদের উদ্ধারে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নদীতে নেমে পড়ে। তারা নদীতে মানববর্ম (মানববন্ধনের মত করে) করে লাশ খুঁজতে থাকে। অনেকে লাঠি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় নদীর এপার থেকে ওপার খোঁজাখুঁজি শুরু করে। দুপুরের পর থেকে একে একে বিভিন্ন এলাকায় লাশ ভেসে উঠতে থাকে। একেকটা লাশ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে শত শত মানুষ পরিচয় খুঁতে সেখানে ভিড় করে। স্বজন হারানো মানুষ নদীর পাড়, ইউনিয়ন পরিষদসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে থাকে। না পেয়ে মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের সামনে ছবিসহ নিখোঁজদের ছবি টানিয়ে দেওয়ার স্থানে শত শত মানুষ স্বজনদের দেখতে ভিড় জমায়।
লাশ উদ্ধারের পর তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রের অনুমোদন সাপেক্ষে লাশগুলো নিজ নিজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর পরই পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায়কে কমিটির প্রধান করা হয়। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া, ঘাট ইজারাদারের অবহেলা, মন্দির কমিটির নেতাদের অবহেলার কারণেই মূলত এই নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে। শৃঙ্খলা ও সাবধানতা অবলম্বন করা হলে এ দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত।
জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলা পরিষদের অধীন আউলিয়ারঘাট খেয়াঘাটটির ইজারা নিয়েছেন আব্দুল জব্বার নামে সাবেক একজন মেম্বার। ঘটনার পর থেকেই তিনি পলাতক রয়েছেন।
পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহাবুবুল ইসলাম বলেন, আমরা উদ্ধার অভিযান নিবিড়ভাবে পরিচালনা করছি। গত দুদিনে স্থানীয়দের সহায়তায় ৫০টি মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। নিখোঁজদের উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু আনছার মো. রেজাউল করিম শামীম জানান, বেশিরভাগ মানুষের মৃতদেহ সৎকার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর রায় বলেন, আমরা তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে পারব। ইজারাদারের অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। তবে আমরা তাঁকে খুঁজে পাচ্ছি না।
জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, নৌকাডুবির ঘটনায় মৃত, আহতসহ সব ব্যক্তিকেই আমরা বিভিন্নভাবে সেবা ও সহযোগিতা দিয়ে আসছি। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।