জেনে নিন বিদেশে দেশীয় মোবাইল সিম ব্যবহারের উপায়
নিজস্ব প্রতিনিধি সোমবার বিকেল ০৫:৩৭, ২৯ আগস্ট, ২০২২
বিভিন্ন কারণে বিদেশে যাওয়ার সময় দেশে ব্যবহৃত মোবাইল সিমটি সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। অর্থ বিড়ম্বনাসহ বিভিন্ন কারণে অনেকেই বিদেশি সিম নেয়ার বদলে; দেশে ব্যবহৃত সিমটি বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করতে চান।
এজন্য প্রথমেই জানতে হবে মোবাইল নেটওয়ার্কের একটি কারিগরি দিক, যা আন্তর্জাতিক রোমিং নামে পরিচিত। দেশে ব্যবহৃত সিমে রোমিং সিস্টেম চালু করে দেশের বাইরে সেটি ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের শর্ত এবং পূর্বপ্রস্তুতি রয়েছে।
চলুন, দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহারের সেই দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক।
আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম কী
আন্তর্জাতিক মোবাইল রোমিং হলো এমন একটি পরিষেবা যা মোবাইল ডিভাইস ব্যবহারকারীদের অন্য দেশে যাওয়ার সময় ভয়েস কল এবং টেক্সট মেসেজ পাঠানো ও গ্রহণ এবং ইন্টারনেট ব্যবহারে সহায়তা করে।
আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম কীভাবে কাজ করে
একজন মোবাইল ব্যবহারকারী বিদেশে গিয়ে তার মোবাইল ডিভাইসটি চালু করেন, তখন সেটি সেখানকার স্থানীয় মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে। বিদেশি নেটওয়ার্কটি নবাগত ব্যবহারকারীর মোবাইল থেকে সংযোগ গ্রহণ করে। অতঃপর এটি তার সিস্টেমে নিবন্ধিত কি-না তা শনাক্ত করে ব্যবহারকারীর দেশীয় নেটওয়ার্ক শনাক্তের চেষ্টা করে।
দেশ দুটির মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে রোমিং চুক্তি থাকলে বিদেশি নেটওয়ার্ক সিগন্যালকে একটি আন্তর্জাতিক ট্রানজিট নেটওয়ার্কের দিকে রুট করে। আন্তর্জাতিক ট্রানজিট নেটওয়ার্ক ক্যারিয়ার গন্তব্য নেটওয়ার্কে কল ডেলিভারি সম্পন্ন করে। এটি হয়ে গেলে অন্যদিকে গন্তব্য নেটওয়ার্কটি কলটি সংযুক্ত করে।
বিদেশি নেটওয়ার্কটি দেশীয় নেটওয়ার্ক থেকে ব্যবহারকারী সম্পর্কে পরিষেবার তথ্যও অনুরোধ করে, যেমন ব্যবহৃত ফোনটি হারিয়ে গেছে বা চুরি হয়েছে কিনা এবং মোবাইল ডিভাইসটি আন্তর্জাতিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত কি-না।
ফোনটি ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত হলে বিদেশি নেটওয়ার্ক ডিভাইসটির জন্য একটি অস্থায়ী গ্রাহক রেকর্ড তৈরি করে। একই সঙ্গে দেশীয় নেটওয়ার্ক ডিভাইসটি কোথায় অবস্থিত তার গ্রাহক রেকর্ড আপডেট করে, যাতে ফোনে কল করা হলে এটি যথাযথভাবে রাউট করা যায়।
অর্থাৎ, কোনো বাংলাদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন। তার মোবাইল সিমটি সে দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক কর্তৃক অনুমোদিত হলে সেটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক সিস্টেমে সংযুক্ত হয়ে যাবে।
অতঃপর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয় দেশের অপারেটর গ্রাহকটির যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ করবে। বাংলাদেশি সিমটির সেবা ব্যবহারের চার্জ ধার্য হবে যুক্তরাষ্ট্রের কলরেট অনুযায়ী। এ সময় সিমটিতে যাবতীয় ইনকামিং-আউটগোয়িং-এর জন্য চার্জ ধরা হবে।
দেশের সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহার করার নিয়ম
রোমিং সার্ভিস সক্রিয় করার উপায়-
সিম কার্ডে আন্তর্জাতিক রোমিং সক্রিয় করতে হলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানির অফিসে যেতে হবে। এ সময় যা যা প্রয়োজন হবে তা হলো-
-ন্যূনতম ৬ মাস মেয়াদের আন্তর্জাতিক ক্রেডিট কার্ড (উভয় দিকের ফটোকপি)
-প্রিপেইড সিমের জন্য সঠিকভাবে পূরণকৃত আইআরএফ (আন্তর্জাতিক রোমিং ফর্ম)
-আইএসডি (আন্তর্জাতিক সাবস্ক্রাইবার ডায়ালিং) সংযোগসহ প্রিপেইড সংযোগের সাবস্ক্রিপশন নথির ফটোকপি
-পাসপোর্টের ফটোকপি (প্রথম পাঁচ পৃষ্ঠা)
-ব্যবহারকারীর দুই কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি
– আন্তর্জাতিক কারেন্সি অ্যাকাউন্ট-এ শুরুতে স্ট্যান্ডার্ড প্রিপেইড রোমিং সার্ভিসের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২৫ ডলার জমা রাখতে হবে। পরবর্তীতে প্রতিবার ১০ ডলার জমা করা যাবে।
এসব কাগজপত্র জমার পর সিম কোম্পানি থেকে আন্তর্জাতিক রোমিং সার্ভিস চালু করে দেবে।
দুই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কের মধ্যে সামঞ্জস্যতা
মোবাইলের নেটওয়ার্কের ধরন তথা জিএসএম ৯০০/১৮০০/১৯০০/অন্যান্য সংস্করণগুলো অবশ্যই বিদেশি নেটওয়ার্কের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এজন্য বিদেশযাত্রার আগে সঠিক মোবাইল নেটওয়ার্ক বা সিম কোম্পানি নির্বাচন করে নিতে হবে। এই কাজটি দুটি উপায়ে করা যায়-
প্রথমত, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা অপারেটর সিলেকশন অপশনটি যদি অটোমেটিক করা থাকে, তাহলে মোবাইল নিজে থেকেই বিদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয়ে যাবে। চলাফেরার সময় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নেটওয়ার্কের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে হ্যান্ডসেটটি নিজে থেকেই নেটওয়ার্ক পরিবর্তন করে নেবে। অর্থাৎ, আশেপাশে যেখানেই নেটওয়ার্ক সিস্টেম ভালো হবে সেটি স্বয়ংক্রিয় ভাবে সংযুক্ত হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা অপারেটর সিলেকশন অপশনটি ম্যানুয়েল হলে ব্যবহারকারিকে একটি নেটওয়ার্ক বেছে নেওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম চালু করতে হবে।
আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম চালু করার পদ্ধতি
মোবাইল অপারেটরের ওপর নির্ভর করে প্রথমে এর নেটওয়ার্ক সিলেকশন, ফোন সেটআপ বা সেটিংস মেনুতে প্রবেশ করতে হবে। এরপর সার্চ করলে বেশ কিছু সময় ধরে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিভিন্ন নেটওয়ার্ক খুঁজতে থাকবে। আশেপাশে কোন নেটওয়ার্ক থাকলে তা মোবাইলের স্ক্রিনে দেখাবে এবং সেগুলোর মধ্যে থেকে যে কোনটিতে প্রেস করে নেটওয়ার্কটির সাথে সংযুক্ত হওয়া যাবে।
আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড
এবার সিমটি ব্যবহার অর্থাৎ বিদেশ থেকে বাংলাদেশে বা অন্যান্য দেশে কল করতে প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড। এর মাধ্যমে সহজেই সিমটি ব্যবহার করে অন্যান্য দেশগুলোতে কথা বলা যাবে। অধিকাংশ দেশের অ্যাক্সেস কোড হলো + (প্লাস) বা ০০। এই আন্তর্জাতিক অ্যাক্সেস কোড (+ ০০)-এর পর কাঙ্ক্ষিত দেশের কান্ট্রি কোড দিয়ে ফোন নাম্বারটি ডায়াল করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, + তারপর ৬০ (কান্ট্রি কোড) এবং সবশেষে (ফোন নাম্বার) ০০ ৬০ (ফোন নাম্বার)। নিম্নে বিভিন্ন দেশের অ্যাক্সেস কোড উল্লেখ করা হলো:
যুক্তরাষ্ট্র- ০১১, কানাডা- ০১১ +, জর্জিয়া- ৮১০ +, হংকং- ০০১ +, সিঙ্গাপুর- ০০১ (সিংটেল); ০০২ (মোবাইলওয়ান); ০০৮ (স্টারহাব), কাতার- ০০, সৌদি আরব- ০০, থাইল্যান্ড- ০০১, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিস- ০১১, সেন্ট লুসিয়া- ০১১, সেইন্ট ভিনসেন্ট- ০১১, জার্মানি- ০০, মালয়শিয়া- ০০, ক্যামেরুন- ০০৭ ০০১, আবখাযিয়া- ৮১০ +, অ্যাঙ্গুইলা- ০১১, ক্যাম্বোডিয়া- ০০৭ ০০১, কেম্যান আইল্যান্ড- ০১১, গ্রানাডা- ০১১ +, ইন্দোনেশিয়া- ০০১ / ০০৭ / ০০৮, কেনিয়া- ০০০, নাইজেরিয়া- ০০৯, প্যারাগুয়ে- ০০২ +, ব্রাজিল- ০০১৪, দক্ষিণ আফ্রিকা- ০৯, তানজানিয়া- ০০০, তাজিকিস্তান- ৮১০, উগান্ডা- ০০০ +, উজবেকিস্তান- ৮১০|
আন্তর্জাতিক রোমিং সার্ভিস এর মাধ্যমে এসএমএস পাঠানো
বিদেশে যাওয়ার পর দেশীয় সিম দিয়ে সেই দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে মেসেজ পাঠানোর জন্য নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে।
প্রথমে যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হচ্ছে, যার কাছে এসএমএসটি যাবে তার মোবাইল নম্বর যেন অবশ্যই আন্তর্জাতিক ফরম্যাটের হয়। সুতরাং আন্তর্জাতিক অ্যাকসেস কোড + অথবা ০০, তারপর কান্ট্রি কোড এবং সবশেষে মোবাইল ফোন নম্বর দিন। এখানে যেসব দেশের কান্ট্রি কোডের শেষে শূন্য এবং মোবাইল ফোন নাম্বার শূন্য দিয়ে শুরু, সেসব দেশের জন্য কান্ট্রি কোডের শূন্যের পর মোবাইল ফোনের শূন্য দেয়া যাবে না। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের গ্রামীণফোনের কোন নাম্বারে এসএমএস পাঠাতে হলে, +৮৮০-এর পর মোবাইল ফোন নাম্বারের বাকি দশটি ডিজিট দিতে হবে।
এমনকি এসএমএস সেন্টারের নাম্বারও আন্তর্জাতিক ফরম্যাটে সেইভ করে রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক রোমিং সিস্টেম সার্ভিস-এর বদৌলতে একবার এসএমএস সেন্টারের নাম্বার আন্তর্জাতিক ফর্ম্যাটে সেইভ করার পর তা আর পরিবর্তন হয় না। পরবর্তীতে সেই দেশ থেকে অন্য দেশে বা নিজের দেশে ফেরত এলেও ম্যাসেজ পাঠানোর জন্য নতুন করে আর নাম্বারটি পরিবর্তন করতে হয় না। বাংলাদেশে যেভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে এসএমএস লেনদেন হতো, ঠিক সেভাবেই সব জায়গাতেই এসএমএস পাঠানো যাবে।
পরিশিষ্ট
দেশের মোবাইল সিম বিদেশের মাটিতে ব্যবহারের পূর্বে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা জরুরি। সদ্য দেশ থেকে বিদেশে যাওয়া লোকদের জন্য আর্থিক দিকটিকে বেশি আমলে নিয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো কোনো বিকল্পের দিকে লক্ষ্য দেওয়া উচিত।
কারণ, উপরোক্ত তথ্যগুলো এ বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, আন্তর্জাতিক রোমিং ব্যবস্থা নিয়ে ঝামেলাহীন সেবা দিতে বাংলাদেশের টেলিকম ইন্ডাস্ট্রির এখনো বেশ সময় লাগবে।