ঢাকা (সন্ধ্যা ৬:২৭) মঙ্গলবার, ৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

চাঁপাইনবাবগঞ্জে স্বপ্ন বুনেছেন নকশি কাঁথার সফল উদ্যোক্তা তাহারিমা

এস এম সাখাওয়াত জামিল দোলন,চাঁপাইনবাবগঞ্জ এস এম সাখাওয়াত জামিল দোলন,চাঁপাইনবাবগঞ্জ Clock বুধবার দুপুর ০৩:৫৩, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অন্যতম নির্দেশক পণ্য নকশি কাঁথায় স্বপ্ন বুনে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন নূর নকশী মহিলা জাগরণের স্বত্বাধিকারী সফল নারী উদ্যোক্তার সম্মাননা প্রাপ্তা তাহারিমা বেগম। গত ৩৮ বছর ধরে কাপড়ের উপর রঙিন সুতার ফোঁড়ে সারাদেশের নকশি কাঁথা শিল্পে সৃষ্টি করেছেন অন্যন্য উদাহরণ। ইতোমধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তৈরি তাহারিমা বেগমের নকশি কাঁথার পরিচিতি ও সুনাম সারাদেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। নকশি কাঁথার পাশাপাশি বহুমুখী ব্যবহারের চিন্তা থেকে বিভিন্ন ডিজাইনের বেডশিট, পর্দা ও গৃহসজ্জার উপকরণ তৈরি করছেন তিনি। আর এতেই নিজেকে সফল করার পাশাপাশি তৈরি করছেন আরো অনেক নতুন উদ্যোক্তা। তাহারিমা বেগমের নকশি কাঁথা শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে গৃহবধূ, বিধাব নারী, স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ও শিক্ষার্থীসহ সমাজের অসহায়, পিছিয়ে পড়া কয়েক হাজার নারীর।

সফলতার স্বীকৃতি হিসেবে দেশ-বিদেশে নানা সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ইসলামপুর মহল্লার এস.এম. আব্দুল বাকীর সহধর্মিণী তাহারিমা বেগম। ৭ম জাতীয় এসএমই পণ্য মেলা-২০১৯ এ নারী ক্যাটাগরিতে বর্ষ সেরা মাইক্রো উদ্যোক্তা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছেন তাহারিমা বেগম। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল হালিম ও এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন কে.এম হাবিব উল্লাহর উপস্থিতিতে দেশ সেরা সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তাহারিমা বেগমের হাতে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন তুলে দেন ১ লক্ষ টাকা, ট্রফি ও সার্টিফিকেট।

বর্তমানে তাহারিমা বেগমের অধীনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা, শিবগঞ্জ উপজেলা, নাচোল উপজেলা এবং রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীতে মোট ১৫টি এজেন্টের মাধ্যমে প্রায় ২ হাজারের অধিক বিভিন্ন বয়সী নারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। ঘরে বসেই সংসারের পাশাপাশি নূর নকশী’র বিভিন্ন পন্য তৈরি করছেন এসব নারীরা। তাদের বাড়ি থেকে সংগ্রহ করে জেলা শহরের ইসলামপুরে নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র নূর নকশীতে বিক্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসেন এই ১৫টি এজেন্ট। এরপর নূর নকশী হতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জে তাহারিমা বেগমের নকশি কাঁথা। নূর নকশীর নকশি কাঁথা, হোম ডেকর, হ্যান্ডিক্রাফট ও নকশি ব্যাগ, নকশী চাদর, কুশন কভারসহ বিভিন্ন আধুনিক পণ্য নিয়ে নূর নকশী পৌঁছে গেছে আন্তর্জাতিক বাজারেও। ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মেলায় অংশগ্রহণ করে পণ্য প্রদর্শণ ও বিক্রি করে আসছেন তারা। ২০১৮ সালে উড়িষ্যার প্রাদেশিক সরকারের আমন্ত্রণে এসএমই আন্তর্জাতিক বানিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করেন সফল নারী উদ্যোক্তা তাহরিমা বেগম। তখন থেকেই ভারতের উড়িষ্যায় বানিজ্যিকভাবে তাহারিমার নকশী কাঁথা রপ্তানি শুরু হয়। মান বিবেচনায় উন্নত ও অন্যন্য হওয়ায় সেখানে তাহারিমার নকশী কাঁথার চাহিদা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।

এ বিষয়ে সফল নারী উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম বলেন, ১৯৮২ সালে নিজের তৈরি একটি নকশি কাঁথা ১৩০০ টাকায় বিক্রি করতে পেরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পুরোদমে বানিজ্যিক চিন্তা নিয়ে কাজ শুরু করি। কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছি নকশী কাঁথার বিক্রয় কেন্দ্র ‘নূর নকশী’। স্বামী ও পরিবারের সকলের সহযোগিতায় প্রায় ৪ দশকের যাত্রা চলমান রয়েছে। নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা প্রশংসনীয় উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, গ্রামের অসহায়, কর্মহীন নারীদের জন্য কিছু করতে পারাটা সবসময় আমার কাছে গর্বের। আমার আজকের এই অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে ঘরে বসে কাপড় আর রঙিন সুতায় ফোঁড় বুনা সকল নারীদের।

একেকটি নকশিকাঁথা তৈরিতে রকম ভেদে সময় লাগে ১-৩ মাস পর্যন্ত। যেগুলোর দাম ৯০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত। উদ্যোক্তা তাহারিমা বেগম মহিলা সংস্থা ও ইফাদসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নকশী কাঁথা বিষয়ক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। নকশী কাঁথা তৈরি যেহেতু সময় সাপেক্ষ পদ্ধতি, সেহেতু বর্তমানে নারীরা যাতে স্বল্প সময়ে নতুন কিছু তৈরি করতে পারেন সেই পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন তাহারিমা বেগম। শত রকমের নকশী কাঁথা রয়েছে তাহারিমা বেগমের নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রে। বর্তমানে প্রায় সকল অভিজাত শ্রেণীর বাসার এসি রুমে নকশী কাঁথার দেখা মিলে। তাই নকশী কাঁথাকে অনেকেই নাম দিয়েছেন এসি কাঁথা।

নূর নকশীর এজেন্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার চরমোহনপুর এলাকার মো. মোস্তফা বলেন, আমার অধীনে সাড়ে ৩ শত নারী নকশী কাঁথা তৈরির কাজ করে। তাদেরকে কাপড় ও সুতা সরবরাহ করা হয়। এরপর তৈরি শেষ হলে নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করা হয়। এতে এজেন্ট হিসেবে প্রত্যেক কাঁথায় আমার ২ শত থেকে ৩ শত টাকা লাভ থাকে। এতে বাড়ির মেয়েদের যেমন কর্মসংস্থান হয়েছে, ঠিক তেমনি আমিও লাভবান হতে পেরেছি।

রাজমিস্ত্রী স্বামীর গৃহবধূ মুক্তারা খাতুন বলেন, সংসারের সব কাজ শেষ করে দুপুরের পর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত তেমন কোন কাজ থাকে না। আগে সে সময় শুধুশুধু বসেই পার করতাম। কিন্তু এখন নূর নকশীর কাঁথা তৈরি করি। মাসে একটা করে কাঁথা তৈরি করে ৭ শত টাকা থেকে ৮ শত টাকা পর্যন্ত পায়। এই টাকা দিয়ে ছেলের স্কুলের ফি, খাবারসহ সংসারের বিভিন্ন কাজে লাগাতে পারি।

নবাবগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী রওশন আরা পপি জানান, দীর্ঘদিন ধরে বাসায় মা, দাদি কাপড়ের ওপর সুতার বুণনে নকশা তৈরী করে নকশী কাঁথা তৈরী করে আসছেন। আর করোনা কালে কলেজ বন্ধ থাকায় তাদের সাথে আমিও গত ৮-৯ মাস থেকে নকশী কাঁথা তৈরি করছি। সময়ও কাটছে কাজও শেখা হচ্ছে। সেই সাথে কিছু টাকা উপার্জন করতে পারছি। ভবিষ্যতে আমারও ইচ্ছে নকশী কাঁথার বানিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে স্বাবলম্বী হবার।

জেলা পরিষদের সদস্য ও সাবেক উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শান্তনা হক নূর নকশী বিক্রয় কেন্দ্রের একজন নিয়মিত ক্রেতা। বিক্রয় কেন্দ্রে একটি নকশী কাঁথা নিতে এসেছেন আত্মীয়কে উপহার দেয়ার জন্য। তিনি বলেন, এখানকার নকশী কাঁথাগুলো খুবই উন্নত মানের ও খুব সহজেই ক্রেতা আকৃষ্ট করার মতো ডিজাইনের। তাই ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবের জন্য উপহার হিসেবে বিভিন্ন ডিজাইনের নকশী কাঁথা দিতে মাঝে মধ্যেই এখানে আসতে হয়।

এ সকল বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প কর্পোরেশন-বিসিক চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ আজাদ হোসেন জানান, বিসিকের প্রধান কাজই হলো উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিসিক বিভিন্ন প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ঋণের ব্যবস্থা করাসহ সকল দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। একজন সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গর্ব নূর নকশীর তাহারিমা বেগম। অনেক সংগ্রাম করে আজ তিনি এই অবস্থানে আসতে পেরেছেন। তার এই সফলতার অংশীদার হতে পেরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিসিক খুবই আনন্দিত ও গর্বিত। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে নূর নকশী সারাদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জণ করেছে। এমনকি দেশের বাইরেও রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। এটা জেলার জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আর তাই আমরা চাই তাহারিমা বেগমকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে জেলার নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করতে এগিয়ে আসবে।




শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

মেঘনা নিউজ-এ যোগ দিন

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর



© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT