আজ সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকী
নিজস্ব প্রতিনিধি সোমবার রাত ০১:৪৩, ৩০ মে, ২০২২
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪১তম শাহাদতবার্ষিকী আজ সোমবার। বহুদলীয় গণতন্ত্র, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ এবং উৎপাদনমুখী রাজনীতির প্রবক্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান পরিচিতি পেয়েছিলেন অতি অল্প সময়ে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে একদল বিপথগামী সেনাসদস্যের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সেক্টর কমান্ডার।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছেন জিয়াউর রহমান। তিনি দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য হানাদারদের বিরুদ্ধে সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বীরত্বসূচক অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সরকার তাঁকে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত করে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসা জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল। তার পরের বছর ১ সেপ্টেম্বর আত্মপ্রকাশ করে জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে সারা দেশে ১০ দিনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির নেতারা দিনটি স্মরণ করে বলেন, ‘শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার। তিনিই জাতির সংকটময় মুহূর্তে বারবার দাঁড়িয়েছেন নির্ভয়ে, মাথা উঁচু করে। বিপর্যস্ত জাতিকে রক্ষা করেছেন সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত এক পরিস্থিতি থেকে দেশ মুক্তি পায় ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে। আর এ বিপ্লবের প্রাণপুরুষ ছিলেন জিয়াউর রহমান।’
নেতারা বলেন, ‘গণতন্ত্র হত্যা ও অরাজকতার অমানিশার দুর্যোগের মুখে দেশের সিপাহি-জনতার মিলিত শক্তির মিছিলে জিয়াউর রহমান জাতীয় রাজনীতির পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হন। ফিরিয়ে দেন বহুদলীয় গণতন্ত্র, সংবাদপত্র ও নাগরিক স্বাধীনতা। তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা করেন। উৎপাদনের রাজনীতির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন। বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করেন। আধুনিক ও স্বনির্ভর দেশ গঠনের পদক্ষেপ নেন তিনি।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “মহান স্বাধীনতার ঘোষক, ৭১-এর রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা, আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি, দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের ৪১তম শাহাদাৎবার্ষিকীতে আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। শহীদ জিয়ার প্রবর্তিত কালজয়ী দর্শন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ও তাঁর অবিনাশী আদর্শ এ দেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষা এবং বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার।’’
রোববার এক বিবৃতিতে মহাসচিব আরও বলেন, ‘জাতির সব ক্রান্তিকালে জিয়াউর রহমান দেশের মানুষের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি সব সংকটে দেশ ও জনগণের পক্ষে অবস্থান নেন। মহান স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা, স্বাধীনতা যুদ্ধের ময়দানে বীরোচিত ভূমিকা এবং একটি নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে তাঁর অনবদ্য অবদানের কথা আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রারম্ভে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতায় দেশের মানুষ যখন দিশেহারা, ঠিক সেই মুহূর্তে ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা সারা জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জীবিত করেছে। এই ঘোষণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের তরুণ, যুবকসহ নানা স্তরের মানুষ মরণপণ যুদ্ধে শামিল হয়।’
বিএনপির নেতারা বলেন, “দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন জিয়াউর রহমান। তিনি নিশ্চিত করেন বাক, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা। তার অন্যতম উপহার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পতাকাবাহী রাজনৈতিক দল ‘বিএনপি’। তাঁর মৃত্যুর পর সহধর্মিণী খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দল তিনবার জনগণের ভোটে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পায়। জিয়াউর রহমানের আদর্শ ধারণ করে তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন খালেদা জিয়া। সরকারের ‘মিথ্যা’ মামলায় তিনি কারগারে (সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে বাসায় রয়েছেন) আছেন।”
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বর্তমান সরকার দেশে একদলীয় শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের নির্মমতা চারদিকে বিদ্যমান। বিরোধীদলের অধিকার, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে বর্তমান সরকার। সেজন্য গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় অন্যায়ভাবে সাজা দিয়ে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এখনও তিনি কার্যত বন্দি। অসুস্থ হয়ে তিনি বর্তমানে চিকিৎসাধীন। তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা ও সাজা প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে হবে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘জাতীয় জীবনের চলমান সংকটে শহীদ জিয়ার প্রদর্শিত পথ ও আদর্শ বুকে ধারণ করেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থ, বহুমাত্রিক গণতন্ত্র এবং জনগণের অধিকার সুরক্ষায় ইস্পাতকঠিন গণঐক্য গড়ে তুলতে হবে।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘একদলীয় বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে প্রবর্তন করায় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে সাধারণ মানুষ উপরে স্থান দিয়েছে। জিয়াউর রহমানকে শ্রেষ্ঠ করতে কাউকে ছোট-বড় করতে হয় না। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কর্মকাণ্ডের তুলনা তিনি নিজেই। আমরা যেন ভুল করে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অন্য কারো তুলনা করতে না যাই। জিয়াউর রহমান চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবেন।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘জিয়াউর রহমান সর্বকালের একজন সর্বশ্রেষ্ঠ দেশপ্রেমিক। তিনি একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। একজন সর্বশ্রেষ্ঠ সংগঠক ছিলেন। একটি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সাংগঠনিক দক্ষতা দরকার। এটি অল্প সময়ের মধ্যে করতে পেরেছিলেন তিনি। পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি মুক্তিযুদ্ধে সবাইকে মাঠে নামাতে পেরেছিলেন এবং সম্মুখভাগে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে যুদ্ধ করেছেন।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আরও বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় জিয়াউর রহমান ইচ্ছে করে আসেননি। সিপাহি জনতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছে। জনগণ যে প্রত্যাশা নিয়ে তাঁকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এনেছিল তিনি জনগণের সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছেন।’
শোকাবহ এ দিন স্মরণে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণসহ ১০ দিনের কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো। শাহাদাৎবার্ষিকী যথাযথ মর্যাদায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে পালন করতে দল, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সব স্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
রোববার রাজধানীর রমনায় ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স মিলানায়তনে বিএনপির উদ্যোগে আলোচনা সভা হয়। ১০ দিনের কর্মসূচি শুরু হয় রোববার থেকে। সোমবার ভোর ৬টায় রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ এবং কালো পতাকা উত্তোলন এবং নেতাকর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এ ছাড়া বেলা ১১টায় দলের মহাসচিবসহ জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ ও মাজার জিয়ারত করবেন। এর পরপরই ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পর্যায়ক্রমে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ ও মাজার জিয়ারত করবে।
একই সঙ্গে সারা দেশের জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা, পৌরসভাসহ সব ইউনিট কার্যালয়ে বিএনপির উদ্যোগে জিয়াউর রহমানের শাহাদৎবার্ষিকী উপলক্ষে ৩০ মে ভোর ৬টায় দলীয় পতাকা অর্ধ্বনমিতকরণ, কালো পতাকা উত্তোলন এবং নেতাকর্মীরা আলোচনা সভা, দোয়া মাহফিল এবং দুস্থদের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী, বস্ত্র বিতরণ করবে।
বিএনপির অঙ্গদলের মধ্যে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাস ও জাতীয়তাবাদী কৃষকদল- আগামী ১ জুন, জাতীয়তাবাদী তাঁতী দল ৪ জুন, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ৫ জুন, জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দল ৬ জুন, জাতীয়তাবাদী মৎস্যজীবী দল ৭ জুন আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।