ঘনঘন লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ জনজীবন
নিজস্ব প্রতিনিধি বুধবার রাত ০১:১২, ৬ জুলাই, ২০২২
দেশের বিভিন্ন স্থানে লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। রোদ ও ভ্যাপসা গরমে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুতের কোনো কোনো গ্রাহক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। অনেকে বিরক্তি প্রকাশ করে দিচ্ছেন ফেসবুকে পোস্ট।
লোডশেডিংয়ের কারণে রংপুরে হিমাগারের রাখা পণ্যের ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। নাটোরে চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প–কলকারখানা ও কৃষিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়। নওগাঁর আউশ ও রোপা আমনের ক্ষেতে সেচসংকট দেখা দিয়েছে। সিরাজগঞ্জে কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
নওগাঁয় লোডশেডিংয়ের কারণে ভোগান্তির মধ্যে আছে মানুষ। কলকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। আউশ ও রোপা আমনের খেতে সেচ দিতে সংকটে পড়েছেন কৃষক।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলা সদরের লিচুবাগান এলাকার গৃহিণী জান্নাতুন ফেরদৌস বলেন, সারা দিনে কতবার বিদ্যুৎ যায়, তার হিসাব নেই। এক সপ্তাহ ধরে শুধু রাতেই পাঁচ-ছয় ঘণ্টা ধরে লোডশেডিং হচ্ছে। গরমের কারণে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। বাচ্চাটার ঠিকমতো পড়াশোনাও হচ্ছে না।
নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নওগাঁর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস–স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ সরবরাহ পাচ্ছেন। এ কারণে ঘন ঘন লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
নওগাঁ পল্লী সমিতি-১–এর উপমহাব্যবস্থাপক (কারিগরি) প্রকৌশলী লুৎফুল হাসান সরকার বলেন, নওগাঁ পল্লী সমিতি-১-এর গ্রাহক সংখ্যা ৪ লাখ ৬০ হাজার। এই পরিমাণ গ্রাহকের প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা গড়ে ৯০ মেগাওয়াট। তবে বর্তমানে পাওয়া যাচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ মেগাওয়াট করে।
বিদ্যুৎ সঞ্চালন প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের লিমিটেড (পিজিসিবিএল) রাজশাহী কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গ্যাসের চাপ কম থাকায় জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কয়েক দিন আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বিষয়টির ব্যাখ্যা করেছেন।
রংপুর জেলায় প্রতিদিন বিদ্যুতের চাহিদা ১৫০-১৫৫ মেগাওয়াট। সেখানে চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৮০-৮৫ মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি থাকায় জেলায় দিনে ও রাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বাসাবাড়ির লোকজন চরম দুর্ভোগে পড়েছে।
নেসকো রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন বলেন, রংপুর বিভাগের আট জেলায় রাতে বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৯০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে ৪৫০ মেগাওয়াট, অর্থাৎ চাহিদার বিপরীতে অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। মঙ্গলবার দিনের বেলা এই বিভাগে বিদ্যুতের চাহিদা ৬৫০ মেগাওয়াট, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ৪০০ মেগাওয়াট; অর্থাৎ ২৫০ মেগাওয়াট ঘাটতি।
বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতিতে রংপুর নগরের বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকেরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। রংপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বলেন, টানা লোডশেডিংয়ের কারণে হিমাগারগুলো বেহাল। জেনারেটর দিয়ে হিমাগার চালানো হচ্ছে। হিমাগারের তাপমাত্রা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিড থেকে চাহিদা অনুযায়ী অনেক কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করায় এই দুর্যোগ দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন নেসকো রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদত হোসেন।
সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় ছয় দিন ধরে লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হওয়া ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।
নেসকো সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুর রউফ বলেন, সিরাজগঞ্জ শহরের জন্য কমপক্ষে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিদিন থাকলেও, পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৪-১৫ মেগাওয়াট। জাতীয় গ্রিড থেকে প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সরবরাহ না দিলে কিছুই করার নেই।
নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২৪ ঘণ্টায় ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। দেশের উষ্ণতম স্থান হিসেবে পরিচিত এই উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ। সাংসারিক কাজকর্ম থেকে শুরু করে চিকিৎসা, শিক্ষা, শিল্প–কলকারখানা ও কৃষিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। কবে নাগাদ এই বিপর্যয় কাটবে, তা বিদ্যুৎ বিভাগ সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না।
নাটোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–২–এর লালপুর জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) রেজাউল করিম খান বলেন, উপজেলায় আটটি ফিডারে পর্যায়ক্রমে দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের পর এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
উত্তর লালপুর গ্রামের প্রবীণ গৃহিণী রেহেনা বেগম বলেন, তার ছেলে-মেয়ে সবাই বাইরে থাকেন। সাত দিন পরপর খাবারদাবার কিনে ফ্রিজে রেখে দেন। দিনের বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রিজের খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে তাদের পক্ষে জীবন যাপন করা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
চামটিয়া গ্রামের অর্থি আফসানার ভাষ্য, তিনি জাপানে পড়ালেখা করেন। প্রায় তিন বছর পর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে স্বামীকে নিয়ে গত সোমবার বাবার বাড়িতে এসেছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত বিদ্যুৎ না থাকায় তারা ঘুমাতে পারছেন না। রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
রংপুরের বদরগঞ্জে লোডশেডিংয়ে জনজীবনে ভোগান্তি নেমে এসেছে। এ জন্য রংপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২–এর উপমহাব্যবস্থাপকের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে মাইকিং করা হয়েছে। গত রোববার বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত বদরগঞ্জ উপজেলা সদরে ওই মাইকিং করা হয়।
গ্রাহকদের অভিযোগ, আট দিন ধরে উপজেলায় লোডশেডিং হচ্ছে। এতে গ্রাহকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ফেসবুকে পল্লী বিদ্যুৎ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন।