ঢাকা (রাত ৪:৪১) মঙ্গলবার, ৩০শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং

হারিয়ে যাবার গল্প



হারিয়ে গেছে পালের নৌকা

মোঃ বুলবুল হোসেন

 

 

তখন ১৯৮৬ সাল আমাদের গ্রামের চতুর দিকে ছয় মাস পানি থাকত। নৌকা ছাড়া বাহির যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না।  গ্রামের মানুষের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল নৌকা। আমাদের গ্রামে দশ-বারোটা নৌকা ছিল। যেগুলা দিয়ে পাট বোঝাই করে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হতো। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঘুরে আসতে তাদের এক সপ্তাহ সময় লাগত। এই এক সপ্তাহের মধ্যে তারা ধার বৈঠা টেনে নিয়ে যেত আসতো। তারা জনপ্রতি একশত  থেকে দেড়শ টাকা পেত। এই দিয়ে তাদের সংসার চলত। তখন একশত টাকা অনেক মূল্য ছিল। এই টাকা পেয়ে সবাই অনেক খুশি থাকতো।

একবার আমাদের গ্রাম থেকে পাট নিয়ে নারায়ণগঞ্জ এর উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করল। নৌকায় বারোজন লোক ছিল।বড় বড় বিল পাড়ি দিত পাল তুলে নৌকার বৈঠা ধরে।যখন নদীর কাছে আসতো তখন দাঁড় বেয়ে এগিয়ে যেত একজন নৌকার মাঝি ছিল।পালতুলে যখন তারা বিল পাড়ি দিয়ে নদীতে আসলো প্রায় সন্ধা ঘনিয়ে আসছিল। তখন একটি ভালো জায়গা দেখে তারা নোঙ্গর ফেলল। ওই জায়গায় রাত্রি পার করার জন্য। তারা রান্না করে। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া শেষ করল এবং ভাগ করে ঘুমাতে গেল। চোর ডাকাতের ভয় ছিল। আর নৌকা পানি ঢুকলে সেগুলো ফেলে দিতে হতো।যার কারণে ভাগ করে ঘুমাতে যেত।

ভোরে ফজরের আজান দিলে, নামাজ পড়ে সবাই আবার রওনা দিত ধার বেয়ে নদীর পাশ দিয়ে, পরিশ্রমকে পরিশ্রম মনে করতো না। তারা মনের সুখে ভাটিরালি গান গাইতে নদীর পাড় ঘেঁষে এগিয়ে যেত স্রোতের অনুকূলে।এভাবে তিন দিন যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন সকাল বেলায়।নদীর ত্রিমহনা পার হওয়ার সময় নৌকাটা স্রোতের মধ্যে পড়ে যায়।এবং চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে।সবাই ভয়ে আল্লাহকে ডাকতে থাকে। নৌকার মাঝি বলে তোমরা শক্ত হও। আর গুনতে থাকো আমাদের নৌকা কয়টা পাক দিয়েছে।যখন সাতটা পাক দিবে তখন জোরে বৈঠা টানবে।যেমন কথা তেমন কাজ সবাই নৌকার পাক গুনতে থাকে এবং সাতটা পাক হওয়ার পর জোরে বৈঠা টানে ধাক্কা দিয়ে নৌকা স্রোতে উপরে তুলে দেয়। ওখান থেকে আল্লাহর রহমতে বেঁচে যায় নৌকা ও নৌকার মানুষ। তারা আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসে। কিছুদূর এসে তারা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এবং নৌকা এক পাশে থামিয়ে দিয়ে পানি পান করে।

আবার তারা পথ চলতে শুরু করে নদীর পাশ দিয়ে ধার টেনে।এভাবে চলতে চলতে ষষ্ঠ দিন অতিবাহিত হয় এবং ষষ্ঠ দিন রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে।একজনকে পাহারা দেওয়ার জন্য রেখে বাকি সব। একপর্যায়ে পাহারাদার ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের আযানের সকালে ঘুম ভেঙে যায়। নামাজ পড়তে যাবে, এমন সময় দেখে নৌকার একপাশে পাট কম দেখা যায়। নামাজ পড়ে সবাই এলাকার চেয়ারম্যান এর কাছে চলে যায়।এমনকি চেয়ারম্যান অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। সে বুঝিয়ে বলে আপনারা বসেন। দেখছি কি করা যায় আপনাদের জন্য। আপনারা হলেন আমাদের অতিথি আমাদের গাঁয় থেকে পাট চুরি হয়েছে।এটা আমার এলাকার বদনাম। তাই অবশ্যই আপনাদের আমি এ ব্যাপারে সাহায্য করবো। চেয়ারম্যান খোঁজ খবর নিয়ে দুপুরের মধ্যে পাট বাহির করে দেয়।চেয়ারম্যান চোরকে কঠিন শাস্তি দেয়। আমাদেরকে বলে আবার আসবেন কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবেন।অবশ্যই আপনাদের খোঁজ খবর নেবো এই বলে চেয়ারম্যান উৎসাহ দেয়।

আবার সেখান থেকে দুপুরের মধ্যে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য রওনা দেয়। নানান প্রতিকূল পরিবেশের মধ্য দিয়ে একপর্যায়ে পাট এর গন্তব্য স্থল নারায়ণগঞ্জ এসে পৌঁছে যায়।সেখানে মহাজনকে পার্টগুলো বুঝিয়ে দিয়ে সবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে হে আল্লাহ আপনি আমাদের সঠিক ভাবে পৌঁছে দিয়েছেন এজন্য আপনার দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। এরপর সকলেই বৈঠা ধার টেনে মনের আনন্দে বাড়ির দিকে রওনা দেয়।বাড়ির কাছে যখন পৌঁছে যায় পরিবারের সদস্য আপনজনকে দেখার জন্য। নৌকার ঘাটে গিয়ে অপেক্ষা করে প্রিয় মানুষটির জন্য।

গ্রামের সেই দিনগুলো আজ হারিয়ে গেছে। গ্রামে আজ নতুন রাস্তা হয়েছে বিলগুলো ভরে গেছে। নদীতে বাঁধ পড়ছে। ইচ্ছা থাকলেও সেই পালতোলা নৌকা দেখতে পারব না আর। আজ শুধু বলতেই পারব হারিয়ে গেছে পালের নৌকা। শত ইচ্ছা থাকলেও আজ সেই নৌকা চোখে পড়ে না। ফিরে পাবোনা সেই আগের গ্রাম ও গ্রামের ঐতিহ্য।

শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT