সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন সিলেটের রাতারগুল “সোয়াম্প ফরেস্ট”
সামশাদ এস খানম বৃহস্পতিবার রাত ০৩:২২, ৭ এপ্রিল, ২০২২
পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশী থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো সকল ঘটনায় একটা উৎসবমুখর ফিলিংস পাওয়া যায়! যেহেতু দেশের ভিতরে সুযোগ পেলেই সবাই মিলে বেড়িয়ে পরি, আনন্দের আর কূল-কিনারা থাকে না সে সময়গুলোতে।
বড়বোনের পোষ্টিং সিলেটে, অনেকদিন ধরে ঘ্যানঘ্যান করছিল ওর ওখানে যাওয়ার জন্য। কেউ কারো শিডিউল মিলাতে পারছিলাম না। শেষমেশ ছুটি নিয়েই রওনা হলাম সিলেটের উদ্দেশ্যে।
‘ঝক ঝক ঝক ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে অই/ ট্রেন চলেছে, ট্রেন চলেছে, ট্রেনের বাড়ি কই ?’ অবশেষে কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ট্রেন যেয়ে থামলো সিলেট রেলষ্টেশনে। বোন আগেভাগেই তার ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছে আমাদের রিসিভ করার জন্য। আমাদের মতো কামলা শ্রেনীর লোকেরা তো সচরাচর ভাব নেয়ার সুযোগ পায় না বরং অন্যের ভাব দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়! তাই এই সুযোগে সেই পরিমাণ ভাবের সাথে আগে পিছে ফোর্স নিয়ে আমরা রওনা হলাম শহরের দিকে।
যেয়ে দেখি এলাহি আয়োজন করেছে, ওর বাচ্চারাও মহাখুশি আমাদের পেয়ে। সারা সন্ধ্যা কেটে গেলো তুমুল খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডাবাজিতে। বোনের তাড়ায় ঘুমাতে গেলাম কারন পরেরদিন বাংলাদেশের অ্যামাজন জঙ্গলে যাবো সবাই মিলে!
বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী হচ্ছে সারি গোয়াইন নদী। মেঘালয় থেকে নেমে আসা গোয়াইন নদী মিলিত হয়েছে সারি নদীর সাথে। রাতারগুল সোয়াম্প ফরেষ্ট এর পাশেই অবস্থান করছে। সোয়াম্প ফরেষ্ট হচ্ছে পানিতে নিমজ্জিত বন বা জলাবন। এই পানির উৎস স্বাদু হতে পারে, আবার লবনাক্তও হতে পারে।
পৃথিবীতে মোট ২২ টি স্বাদুপানির সোয়াম্প ফরেষ্ট রয়েছে। এর দুইটি আছে আমাদের উপমহাদেশে–একটি শ্রীলংকার ‘ওয়ালাউয়া’ অন্যটি বাংলাদেশের ‘রাতারগুল’।
স্থানীয় ভাষায় পাটিগাছের অপর নাম হল রাতাগাছ। এই বনে ঘন পাটিগাছের আধিক্যের কারণে এর নাম দেয়া হয়েছে রাতারগুল। মোট ৭৩ প্রজাতির গাছগাছালি আছে এখানে। কত রকমের পাখির ডাক যে শুনতে পাওয়া যায়! এ যেন ইট-কাঠ-পাথরের ধূলাময় জগতের বাইরে সম্পূর্ণ অজানা রহস্যময় এক জগত! চোখবন্ধ করে এখানে ছেড়ে দিলে নির্ঘাত মনে হবে অ্যামাজনের বনে আছি!
আমরা গিয়েছিলাম ফেব্রুয়ারী মাসে। ড্রাই সিজন চলছিল তাই বর্ষাকালের মতো থৈ থৈ পানি ছিল না, যদিও বছরে সাতমাসই নাকি পানিতে নিমজ্জিত থাকে এই বন। কয়েকটা ডিঙ্গি নৌকা ভাড়া করে আমরা দলে দলে ঢুকে পড়লাম বনের ভিতরে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, নাম না জানা পাখির ডাক, দুষ্টু বানরের এক ডাল থেকে আর এক ডালে আচমকা লাফ দেয়া দেখতে দেখতে অন্য সঙ্গীদের ছাড়িয়ে কখন যেন আমাদের নৌকাটা ঢুকে পড়লো একটা জনমানবহীন জায়গায়। এতোটাই নিঃশব্দ যে একটা দুটো করে পাতা ঝরে পড়ছে তাও ভীষণভাবে টের পাওয়া যাচ্ছিল!
নৌকার যাত্রীরা সবাই ইশারা করে চুপ হয়ে গেলাম, মাঝিকে বললাম খুব আস্তে আস্তে বাইতে। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সে কি অসম্ভব অশরীরী এক অনুভূতি! প্রত্যেকটা রোম, প্রত্যেকটা কোষ যেন টের পাচ্ছিল প্রকৃতির অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনও! একটা ঘোর, একটা ভালো লাগা মস্তিষ্ককে পুরো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিল কিছুটা সময়ের জন্য। চোখ মেলে মাঝিকে বললাম গান ধরতে। সে কি সুললিত সুর আর দরদভরা কন্ঠ তার।
ওয়াচটাওয়ারে যেয়ে নৌকা থামলো। পুরো এলাকা দেখতে হলে টাওয়ারের উপরে ওঠা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে মনে হল নিঃসন্দেহে এই দেশের আমরা সবাই একেকজন বিশাল বিশাল কবি-লেখক! এর দেয়ালে ভুল বানানে ভরা কত রকম প্রেমের বাণী যে মানুষজন লিখে রেখেছে! ভুল বানান দেখলে (বিশেষ করে যদি সেটা হয় বাংলা) আমার খুব সিক লাগে, নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হয়। তার উপর আছে হরেক রকম বর্নমালাকে ‘+’ চিহ্ন দিয়ে লেখার প্রতিযোগিতা! R+N, A+M, লাভ ইউ জরিনা………হাবিজাবি কত কিছু যে লিখেছে। বাঙালি আসলে অনেক ‘কানেক্টেড’ জাতি! প্লাসে বিশ্বাসী আমরা, মাইনাসে নই!
রাগের চোটে সিড়ি ভেঙ্গে উঠতে উঠতে যখন ওয়াচটাওয়ারের চূড়ায় পৌঁছলাম, সমগ্র রাতারগুল আমার সামনে। টুকরো টুকরো হলদে সবুজ বনের মাঝে মাঝে খৈয়া খাল বয়ে চলেছে। আসলেই কত্ত সুন্দর একটা দেশ আমাদের!
ইচ্ছে আছে ঘোর বর্ষায় রাতারগুল যাওয়ার। সবুজে মাখামাখি হয়ে চলন্ত ডিঙ্গির মাঝে টানটান হয়ে শুয়ে থাকবো। নিচে থাকবে থৈ থৈ পানি, উপরে নীল আকাশ আর দুপাশে সিনেমার রিলের মত সবুজ গাছগাছালি আমাকে নিয়ে ছুটবে অনন্তের পথে এক যুগ থেকে আরেক যুগে!
আর ফিরবো না তোমাদের শহরে, তোমাদের ওই বন্দী খাঁচায়!