ঢাকা (বিকাল ৫:২২) বুধবার, ১লা মে, ২০২৪ ইং

বিদায় নিচ্ছে সিলেটবাসীর দুঃস্বপ্নের বছর ২০২২, নতুন সাল হোক ঘুরে দাঁড়ানোর

বিদায় নিচ্ছে সিলেটবাসীর দুঃস্বপ্নের বছর ২০২২
বিদায় নিচ্ছে সিলেটবাসীর দুঃস্বপ্নের বছর ২০২২



মধ্যখানে মাত্র একটি সূর্যোদয়, শনিবারের (৩১ ডিসেম্বর) সূর্যাস্ত পৃথিবী থেকে চিরকালের জন্য বিদায় দেবে ২০২২ সালকে। রোববারের সূর্যোদয়ের মধ্য দিয়ে সিলেটবাসীর দুয়ারে লুটিয়ে পড়বে নতুন বছর- ২০২৩।

বেশ কিছু ঘটনায় ২০২২ সালে সিলেট ছিলো দেশ-বিদেশে আলোচনায়। ঘটনাগুলোর মধ্যে দুর্ঘটনাই ছিলো বেশি। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কঠোর ও দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলন এবং জেলার ওসমানীনগরে এক প্রবাসী পরিবারের ৩ সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু ছিলো বেশি আলোচনায়। এছাড়াও বছরজুড়ে সিলেটের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিলো উত্তপ্ত। যেন বলা যায়- বিদায়ী বছরে দুর্ঘটনা আর সিলেট ছিলো একসূত্রে গাঁথা, বছরটি সিলেটবাসীর জন্য রেখে যাচ্ছে দুঃস্বপ্ন আর দুর্ভাবনার পদধ্বনি।

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা :

এ বছরে ৩ দফা বন্যার কবলে পড়ে সিলেট মহানগর ও বিভাগ। প্রথম দফা বন্যা আসে মে মাসে। এরপর ১৫ জুন শুরু হয় দ্বিতীয় দফা বন্যা। চলে অন্তত ২০ জুলাই পর্যন্ত। এ সময় পুরো সিলেট বিভাগের চার জেলার অধিকাংশ এলাকাই পানিতে তলিয়ে যায়। এতে বেশ ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হন সিলেট ও সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় এ দুটো জেলার বাসিন্দারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। দিনের পর দিন অধিকাংশ এলাকার মানুষকে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও নেটওয়ার্কহীন কাটাতে হয়েছে। মানুষকে ভুগতে হয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে। ভেসে গেছে গবাদি পশু। দীর্ঘদিন পানিতে তলিয়ে থাকায় অসংখ্য রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে।

তৃতীয় দফা বন্যায় খাবার, সুপেয় পানি ও চিকিৎসার অভাবে বন্যায় সিলেটজুড়ে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। প্রায় এক কোটি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন। কয়েক লাখ বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কেউ কেউ ঘরের ভেতরে মাচা বানিয়ে থেকেছেন। তখন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের বিত্তবান মানুষেরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদি বন্যায় অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন।

তিন দফা বন্যায় বড় সংকটে পড়ে সিলেটের অর্থনীতি। বোরো আর আমনের ফলন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা খাতে ব্যাপক লোকসান হয়েছে।

শাবিতে আন্দোলন :

বছরের শুরুতেই (১৩ জানুয়ারি) শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অসদাচরণসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন কয়েক শ ছাত্রী। ১৬ জানুয়ারি দাবি আদায়ের লক্ষ্যে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করে এবং তাঁদের লক্ষ্য করে শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। পরে এই আন্দোলন উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়।

আন্দোলন চলাকালে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ, অনশন, মশালমিছিল, ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশনা দিলেও শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের পদত্যাগ চেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। তাঁদের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন শুরু করেন।

দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১৯ থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত কোনো ধরনের খাবার না খেয়ে অনশন পালন করেন ২৭ শিক্ষার্থী। ২৫ জানুয়ারি শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হক গিয়ে দাবি পূরণের আশ্বাস দিরলে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ১১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণে আশ্বাস পাওয়ায় ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীরা কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।

ওসমানীনগরে প্রবাসী পরিবারে ট্র্যাজেডি :

২০২২ সালের ২৬ জুলাই জেলার ওসমানীনগরের শয়নকক্ষ থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় যুক্তরাজ্য প্রবাসী পরিবারের ৫ সদস্যকে। তাদের হাসপাতালে পাঠানোর পর ওইদিনই মারা যান গৃহকর্তা রফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে মাইকুল ইসলাম। আর এর ১১ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মেয়ে রফিকুলের মেয়ে সাদিয়া ইসলামও।

এ ঘটনার কারণ খোঁজে বের করতে মেডিকেল বোর্ড গঠন করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তপক্ষ। বোর্ডের প্রধান করা হয় মেডিকেল কলেজটির উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. শিশির চক্রবর্তীকে।

এর আগে গত ২৩ আগস্ট এ ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন করে সিলেটের পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন জানান, খাদ্যে বিষয়ক্রিয়া বা হত্যা নয়। নিছক দুর্ঘটনা থেকেই মারা গেছেন প্রবাসীরা।

পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন জানান, পুলিশের প্রাথমিক অনুসন্ধান এবং নিহত তিনজনের কক্ষে পাওয়া বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করে পর্যবেক্ষণ করে পুলিশ বিষক্রিয়ার কিছু পায়নি। হত্যারও কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই আমাদের ধারণা, ৩ প্রবাসীর মৃত্যু নিছকই দুর্ঘটনা। ঘরের জেনারেটরের ধোঁয়া থেকে এমনটি ঘটে থাকতে পারে বলে ধারণা তার।

জেনারেটরের ধোঁয়ায় কীভাবে একসাথে ৫ জন অসুস্থ ও ৩ জন মারা গেলেন এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার বলেন, প্রবাসীরা ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। নিজেদের ফ্ল্যাটের জন্য তারা আলাদা একটি জেনারেটর ব্যবহার করতেন। সাধারণত জেনারেটর বাড়ির বাইরে চালানো হয়। তবে ওই প্রবাসী পরিবার জেনারেটরটি তাদের ফ্ল্যাটের ভেতরে চালিয়েছিলেন। এতে জেনারেটরের ধোঁয়াও শয়নকক্ষে প্রবেশ করেছিল।

তিনি বলেন, তদন্তকালে আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে জেনারেটর চালিয়ে ওই কক্ষে সাত মিনিটের বেশি অবস্থান করতে পারিনি। জেনারেটর ঘরের মধ্যে থাকার কারণে ধোঁয়ায় টিকে থাকা যাচ্ছিল না। এছাড়া বিকট শব্দও হচ্ছিলো।

প্রবাসীদের শয়নকক্ষে এসিও ছিলো না জানিয়ে তিনি বলেন, তারা শীতের দেশ থেকে এসেছেন। কিন্তু ঘটনার সময়ে এখানে প্রচুর গরম ছিলো। এক কক্ষে গাদাগাদি করে সাত জন শুয়েছিলেন। এদের মধ্যে কয়েকজন অসুস্থও ছিলেন। ঘরে একটি স্ট্যান্ড ফ্যান ও একটি সিলিং ফ্যান চালু চিলো। দরজার পাশে থাকা স্ট্যান্ড ফ্যান বাইরে থেকে জেনারেটরের ধোয়া আরও বেশি শযনক্ষে টেনে আনছিলো। এসব কারণে শাসরুদ্ধ হয়ে তাদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

পুলিশ সুপার বলেন, আমরা সুস্থ হয়ে উঠা রফিকুল ইসলামের স্ত্রী হুছনারা বেগম ও ছেলে সাদিকুল ইসলামের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারাও শত্রুতা বা খাদ্যবিষক্রিয়ার কোন তথ্য জানাতে পারেননি। এছাড়া ওই প্রবাসী পরিবারের সঙ্গে সমাজে, বাড়িতে জায়গা–সম্পত্তি কিংবা অর্থনৈতিক লেনদেন নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। পরিবারটি নিছক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত :

বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ হয়েছে গত ১৯ নভেম্বর। সমাবেশ সফল করতে অন্তত এক মাসজুড়ে সিলেটজুড়ে প্রচারণা চালিয়েছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। তবে প্রচারণায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের বাধা, মামলা ও গণগ্রেপ্তারের অভিযোগ করে বিএনপি। সমাবেশের আগে ছাত্রলীগ মোটরসাইকেল নিয়ে শোভাযাত্রা করলে উত্তেজনা ছড়ায়।

বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে পরিবহন ধর্মঘট আর আওয়ামী লীগের পাল্টাপাল্টি অবস্থান থাকলেও শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি শেষ হয়। ৬ নভেম্বর রাতে আম্বরখানা বড়বাজারে দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জেলা বিএনপির সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল। পরে বিএনপি অভিযোগ তোলে, আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সর্ম্পৃক্তরা কামালকে খুন করেছে।

এদিকে, ২২ অক্টোবর সিলেট মহানগরের ৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাংশের নেতা-কর্মীরা সংবাদ সম্মেলন করে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করে। সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, জাকির বিভিন্ন ওয়ার্ডে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বজনপ্রীতি করে ‘পকেট কমিটি’ তৈরি করছেন।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের দুই সদস্যের কমিটি গঠিত হয় ২৩ অক্টোবর। এরপর উপজেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশ এ কমিটি বাতিলের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করে। এসব কর্মসূচি থেকে অভিযোগ করা হয়, গঠিত কমিটির সম্পাদক হিরন মিয়া বিএনপির সাবেক নেতা। কমিটিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হয়নি।

এসব ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন সময় খুন, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার ঘটনায় সিলেট ছিলো গণমাধ্যমের শিরোনামে। এর মধ্যে ২৫ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাশে গাজী-কালু টিলা লাগোয়া ‘নিউজিল্যান্ড’ এলাকায় বেড়াতে গিয়ে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনা ছিলো বেশ তোলপাড় করা। ওই দিন লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদকে (২২) খুন করে ছিনতাইকারীরা। বুলবুল হত্যাকাণ্ডের পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিতে একাধিক কর্মসূচি পালন করেন। এ ঘটনায় অভিযুক্ত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর




© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT