নিরাপদ পানির জন্য হাহাকার
ডেক্স রিপোর্ট মঙ্গলবার ১২:২৭, ২৩ মার্চ, ২০২১
পুকুরের ময়লা আর ভাসমান পাতা সরিয়ে মাটির কলসি পানিতে ডুবিয়ে দিলেন রোকসানা খাতুন। প্রায় ২০ লিটার পানিতে ধীরে ধীরে ভরে উঠলো কলসি। কলসি ভরে সাবধানে পুকুরের কর্দমাক্ত পাড় বেয়ে ওপরে ওঠেন তিনি। বাড়ি ফিরতে তাকে হাঁটতে হয় প্রায় ৪৫ মিনিট। এই পুরোটা সময় কাঁখে কলসি রেখে চলতে হয়েছে তাকে।
শুধু পরিবারের খাওয়ার পানি জোগাড় করতে সারা বছর জুড়ে এই কষ্ট করতে হয় রোকসানাকে। প্রতিদিন দুবার তিনি কলসিতে করে পানি আনেন। তিনি বলেন, ‘শুধু বর্ষার কয়েক মাসে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারি। তখন পুকুর থেকে পানি না নিলেও হয়।’
চলার পথে বাম হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে পঞ্চাশোর্ধ রোকসানা বলেন, ‘আমাদের বাড়ির পাশে একটা টিউবওয়েল আছে। কিন্তু সেটায় পানি ওঠে না। আর কোনো উপায় নাই, তাই এখান থেকে পানি নেই। বাড়িতে ছয় জন মানুষ জন্য পানি দরকার। তাই বছরের পর বছর ধরে এভাবে পানি নেই।’
খুলনার কয়রা উপজেলার মাদারবাড়ীয়া গ্রামের বাসিন্দা রোকসানার পরিবার এতো কঠোর পরিশ্রম করেও শুধু লবণাক্ত পানি পান। তাদের একমাত্র সান্ত্বনা, পুকুরের পানি অন্যান্য উৎসের চেয়ে কিছুটা কম লবণাক্ত। কয়রা উপজেলার হাতিরডাঙ্গা গ্রামের ৫৩ বছর বয়সী সুষমা সরকার তার বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার দূরের একটি পুকুর থেকে প্রতিদিন কলসি ভরে পানি নিয়ে আসেন। এ কারণে তাকে প্রায়ই পিঠের ব্যথায় ভুগতে হয়। সুষমা বলেন, ‘কেউ কেউ পানি কিনে খায়। কিন্তু আমাদের তো আর সেই সামর্থ্য নেই। গত কয়েকমাসে বৃষ্টিও হয়নি।’
ইউএনডিপি’র সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে দেশের উপকূল অঞ্চলের বাসিন্দাদের নিরাপদ খাবার পানি নিয়ে দুর্দশার চিত্র। এতে বলা হয়েছে, পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলা, খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির বাসিন্দাদের ৭৩ শতাংশকেই ঝুঁকিপূর্ণ লবণাক্ত পানি পান করতে হয়। পানির লবণাক্ততার অনুমোদিত মান প্রতি লিটারে এক হাজার মিলিগ্রাম। জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এই উপজেলাগুলোর মানুষ গড়ে প্রতি লিটারে এক হাজার ৪২৭ মিলিগ্রাম থেকে দুই হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম পর্যন্ত লবণাক্ত পানি পান করেন। শুষ্ক মৌসুমে কিংবা শীতকালে শ্যামনগরের টিউবওয়েলের পানির লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গিয়ে ছয় হাজার ৬০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ছয় গুণেরও বেশি।
‘জেন্ডার রেসপনসিভ কোস্টাল অ্যাডাপটেশন (জিসিএ)’ নামক একটি প্রকল্পের অধীনে জরিপটি পরিচালিত হয় উল্লিখিত পাঁচটি উপকূলীয় উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নের ৬৬ হাজার ২৩৪টি বাড়িতে বসবাসকারী দুই লাখ ৭১ হাজার ৪৬৪ জন মানুষের ওপর। গত ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়া এ জরিপে আরও জানা যায়, ৬৩ শতাংশ মানুষের খাওয়ার পানি পেতে সমস্যায় পড়তে হয়। জরিপে উঠে এসেছে, ৭৪ শতাংশ বাড়িতে পানি সংগ্রহের কাজটি মূলত নারীরা করেন। মাত্র ১০ শতাংশ বাড়িতে এই দায়িত্ব পালন করছেন পুরুষরা। বাকি বাড়িগুলোতে নারী ও পুরুষ মিলেই এই কাজটি করেন। অনেকেই দিনে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করেন পানি সংগ্রহের জন্য। কখনো কখনো টিউবওয়েল বা পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করতে তাদের এক কিলোমিটার বা তারচেয়েও দূরে যেতে হয়। ১৬ শতাংশ বাড়ির বাসিন্দা জানিয়েছেন, তাদের পানির জন্য আরও বেশি পথ হাঁটতে হয়।
জরিপ থেকে জানা যায়, এ অঞ্চলের মানুষের জন্য সহজলভ্য পানির উৎস হিসেবে চিহ্নিত পুকুরগুলোর মধ্যে ৫২ শতাংশ পুকুরের লবণাক্ততার পরিমাণ দেশের অনুমোদিত লবণাক্ততার মান মাত্রার চেয়ে বেশি। টিউবওয়েলের ক্ষেত্রে যা ৭৭ শতাংশ। টিউবওয়েলের পানির গড় লবণাক্ততার পরিমাণ দাকোপে দুই হাজার ৪০৬ মিলিগ্রাম, কয়রাতে এক হাজার ৪৫৩ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় এক হাজার ৫১০ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে ৯৯৮ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে এক হাজার ৬৮৩ মিলিগ্রাম। পুকুরের পানির গড় লবণাক্ততার পরিমাণ দাকোপে ৬৫০ মিলিগ্রাম, কয়রাতে এক হাজার ২৪ মিলিগ্রাম, পাইকগাছায় এক হাজার ৫৮১ মিলিগ্রাম, আশাশুনিতে এক হাজার ২০৩ মিলিগ্রাম ও শ্যামনগরে এক হাজার ১৮৪ মিলিগ্রাম। এসব অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের রাজধানী শহরের তুলনায় পানি সংগ্রহের জন্য বেশি খরচ করতে হচ্ছে।
এই পরিসংখ্যান করা হয়েছে পানি সংগ্রহের পেছনে ব্যয় করা সময়কে বাংলাদেশ সরকারের কাজের বিনিময় খাদ্য প্রকল্পের ঘণ্টাভিত্তিক সম্মানীর সঙ্গে তুলনা করে। জরিপে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে এই কাজের পেছনে সময় দেওয়া হলে তার মূল্যমান দাঁড়ায় মাসে এক হাজার ৮৭৫ টাকা। সে হিসাবে দুই ঘণ্টার বেশি সময় দিলে মাসিক খরচ দাঁড়ায় দুই হাজার ৪৬৩ টাকা। অপরদিকে, ঢাকা ওয়াসা প্রতিটি বাসায় পানি সরবরাহ করার জন্য মাসে মাত্র ২০০ টাকা করে চার্জ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশ সরকার ও গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডের অর্থায়নে পরিচালিত জরিপ প্রকল্পটির সমন্বয়কারী আলমগীর হোসেন জানান, উপকূলীয় এলাকার নিরাপদ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে তারা বৃষ্টির পানিকে কাজে লাগাতে চান। রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং পদ্ধতি (বিশেষ পদ্ধতিতে কূপের মাধ্যমে বৃষ্টির পানি ভূগর্ভে রিজার্ভ) ব্যবহার করে তারা এই কাজ করতে চান। বিরূপ আবহাওয়াতেও এটি ব্যবহারযোগ্য। লবণাক্ত পানি পান করার কারণে স্বাস্থ্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে কি না, সে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে তারা প্রকল্পের শেষভাগে কাজ করবেন। তবে তিনি জানান, ইতোমধ্যেই অনেকে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এর মধ্যে আছে উচ্চ রক্তচাপ, চর্মরোগ, হজমের সমস্যা ও ডায়রিয়া।
প্রায় তিন দশক আগে থেকে উপকূলীয় উপজেলাগুলোর নদীর পানি লবণাক্ত হতে শুরু করলে সেখানকার বাসিন্দারা পানির জন্য মূলত পুকুর ও টিউবওয়েলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। লবণাক্ত পানিতে চিংড়ী চাষের কারণে প্রায় চার দশক আগে থেকেই এসব এলাকার বিভিন্ন মিঠাপানির পুকুরের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।
সাইক্লোন আইলার কারণে ২০০৯ সালে বিভিন্ন পুকুর লবণাক্ত পানিতে ভরে যায়। প্রায় এক দশক পরেও সেগুলোর অবস্থা অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সাইক্লোন আম্পানও একই ধরণের ক্ষতি করেছে। সম্প্রতি এসব এলাকায় ভূমির বিভিন্ন স্তরে লবণাক্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান আলমগীর।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী প্রীতিশ মণ্ডল বলেন, ‘উপজেলাগুলোতে পানির কোনো ঘাটতি নেই। তবে সম্পূর্ণ পানিই লবণাক্ত।’ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আকমাল হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, খুলনা জেলার প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান। বাকিরা পুকুর ও অন্যান্য উৎসের ওপর নির্ভরশীল। উত্তরণ এনজিওর পরিচালক ও সাতক্ষীরার স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামগুলোর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করলে দেখা যায়, গ্রামবাসীদের নিরাপদ পানির জন্য বেশকিছু গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কাজ করে না।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলিপ কুমার দত্ত বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে সবসময়ই ঈষৎ লবণাক্ত পানির প্রভাব দেখা গেছে। ধীরে ধীরে নদী, পুকুর ও অন্যান্য পানির উৎসের লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে।
কীভাবে এই লবণাক্ততার সমাধান করা যায়? জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘গঙ্গা নদীতে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। বাংলাদেশের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প এটাই। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে মিলে গঙ্গা বাঁধ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, ভারত এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে বেশ আগ্রহী। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে যে সুন্দরবনকে বাঁচাতে এবং ওই অঞ্চলের লবণাক্ততা কমাতে গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ খুবই জরুরি।’