সংসদ সদস্য ও তার ভাই উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করে বিপদে নিহতের পরিবার
মোবারক হোসাইন,ধর্মপাশা(সুনামগঞ্জ) মঙ্গলবার দুপুর ০৩:৫৬, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
সুনামগঞ্জ জেলা ধর্মপাশা উপজেলার সুনই জলমহালের বিরোধকে কেন্দ্র করে গত ৭ জানুয়ারি প্রতিপক্ষের দলবদ্ধ হামলায় মৎস্যজীবী শ্যামাচরণ বর্মণকে (৬৫) গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই হত্যার জন্য নিহতের পরিবার স্থানীয় সাংসদ ও তাঁর ভাইদের দায়ী করে থানায় মামলা করতে গিয়েছিল। কিন্তু সাংসদের নাম থাকায় পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে। এখন ভুক্তভোগী পরিবারটি বলছে, প্রভাবশালীদের হুমকিতে শঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। ওই ঘটনার পর থেকে জলমহালে মাছ ধরতে না পারায় জীবিকার সংকটে পড়েছে আরও প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার।
নিহত শ্যামাচরণ ছিলেন সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য ও সুনই জেলেপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তাঁর ছেলে চন্দন বর্মণ ওই সমিতির সভাপতি। চন্দনের অভিযোগ, গত ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় স্থানীয় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন (রতন) এর ছোট ভাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেন (রোকন) এর অনুসারীরা দলবদ্ধ হয়ে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সুনই জলমহালের পাশে তাঁদের স্থাপনায় (খলাঘরে) হামলা চালান। প্রতিপক্ষের লোকজন সেখানে থাকা ১৫-২০ মণ জাল ও একটি খলাঘর আগুনে পুড়িয়ে দেন। এ সময় সমিতির সদস্য ও তাঁদের পরিবারের সদস্যসহ ১৫-২০ জনকে মারধর করা হয়। একপর্যায়ে হামলাকারীরা শ্যামাচরণ বর্মণকে গলা কেটে হত্যা করেন।
ওই ঘটনায় সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন তাঁর দুই ভাইসহ ৬৩ জনকে আসামি করে ধর্মপাশা থানায় লিখিত অভিযোগ করেছিলেন চন্দন বর্মণ। তাঁর অভিযোগ, ওই অভিযোগে সাংসদকে আসামি করায় তাঁর এই অভিযোগ মামলা হিসেবে নেয়নি পুলিশ। পরে এই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ৬০-৬৫ জনকে আসামি করে থানায় একটি মামলা করে। পুলিশের মামলার বিবরণে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বলে চন্দনের অভিযোগ।
এরপর গত ১৪ জানুয়ারি সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, তাঁর দুই ভাইসহ ৬৩ জনকে আসামি করে ধর্মপাশা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন নিহতের ছেলে চন্দন বর্মণ। আদালতের বিচারক একই ঘটনায় থানায় একটি মামলা হওয়ায় এই মামলার প্রতিবেদন থানা থেকে আদালতে আসার আগপর্যন্ত আদালতে করা মামলাটির কার্যক্রম স্থগিতের নির্দেশ দেন।
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, শ্যামাচরণ হত্যাকাণ্ডের রাতেই সন্দেহভাজন হিসেবে ২৩ জনকে আটক করা হয়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকি ২১ জনের মধ্যে ৪ জনকে শ্যামাচরণ হত্যা মামলায় পুলিশের করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এরপর ওই হত্যা মামলায় আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার নয়জনই সাংসদের ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান রোকন এর অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণ পেলে জড়িত ব্যক্তি যত বড় পদের লোকই হোন না কেন, তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। যাঁরা হামলার শিকার হয়েছেন এবং পরিবারের স্বজনকে হারিয়েছেন, তাঁদের প্রতি পুলিশের সুদৃষ্টি রয়েছে বলে জানান তিনি।
আর সাংসদ মোয়াজ্জেম হোসেন রতন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই দিন আমি এলাকায় ছিলাম না। এটি অনেকেই জানেন। যেকোনো ঘটনায় যে কারও দিকে আঙুল তুললেই সে দোষী হয়ে যায় না। রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আমাকে এই ঘটনায় জড়িয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। তবে এই ঘটনায় নিরপরাধ কেউ যাতে শাস্তি না পায়, সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে।’
এখন নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পর থেকে তাঁরা নিরাপত্তা ও জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়েছেন। নিহতের ছেলে চন্দন বর্মণ বলেন, ‘আমার বাবাকে গলা কেটে হত্যা করেও ওদের সাধ মেটেনি। আবারও আমাদের ওপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় আমরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রাতের বেলায় ভালো করে ঘুমোতে পারছি না। বিভিন্ন লোকজনের মাধ্যমে দূর থেকে আসামিপক্ষের লোকজন নানাভাবে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে আসছে।’
ওই ঘটনার পর থেকে সুনই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য ও স্থানীয় মৎস্যজীবীরা আর সুনই জলমহালে মাছ ধরতে পারছেন না। মৎস্যজীবীরা বলছেন, তাঁরা ঋণ করে ছয় বছরের জন্য জলমহালের খাজনার টাকা দিয়েছেন। একদিকে ঋণের চাপ, অন্যদিকে মাছ ধরা বন্ধ। এ কারণে জীবিকা নিয়ে সংকটে পড়েছে প্রায় দেড় শতাধিক পরিবার। নিহত শ্যামাচরণের ছোট ভাই মণীন্দ্রচন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘আমরা তো ছয় বছরের লাইগা সরকাররে খাজনা দিছি। খাজনার টাকা দিতে গিয়ে ঋণও করছি। এহন আমরা জলমহালটাত মাছ ধরতাম পারতাছি না। এই জলমহালের উপ্রে আমরার দেড়শ মানুষের রিজিক। একদিকে ভাই গ্যাছে, অন্যদিকে মাছও ধরতাম পারতাছি না। এহন আমরাও খুব কষ্টে খাইয়া না খাইয়া কাটাইতাছি। ঋণের জন্য চাপও দিতাছে দেনাদাররা।