শামসাদ খানমের ৫ মিনিটের গল্প
নিজস্ব প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার রাত ০১:৪৭, ১৭ মার্চ, ২০২২
ছোটবেলা থেকেই আমার খুব হিংসা। কারোর ভালো দেখলে আমার ভালো লাগে না, ভালো খবর শুনলে সেই রাতে আমার আর ঘুম আসতে চায় না। এ এক কঠিন রোগ, প্রতিনিয়ত যা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, নিঃশেষ করে দিচ্ছে আমাকে একটু একটু করে। অনেকদিন ভেবেছি আমার কি কোনো সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে যাওয়ার দরকার আছে কি না। পরক্ষণেই মনে হয়েছে, ইশ আমি কি পাগল নাকি! নিপাট সুস্থ একজন মানুষ আমি। একজন সফল মানুষ আমি।
প্রথম ব্যাপারটা টের পাই যখন আমার বয়স সাত কি আট হবে। মিট্টি নামে একটা ময়না পাখি ছিল আমাদের। বান্দরবন থেকে বড় মামা পাঠিয়েছিলেন আমার ছোটভাইকে, ওর জন্মদিনের উপহার হিসেবে। এখনো মনে পড়ে মিট্টির কথা। একটু লম্বা ধরনের পাখিটার সরু ঠোঁটের আগায় হালকা হলুদ রঙের একটা আভা ছিল। মাকে দেখতাম খুব আগ্রহ নিয়ে ওকে কথা বলা শেখাতেন। মাসখানেকের মধ্যেই পাখিটা দারুন কথা বলা শিখে গিয়েছিল। আমাকে দেখলেই চেঁচিয়ে উঠতো, “পড়তে বসো, পড়তে বসো”!
প্রথম প্রথম খুব ভালো লাগলেও একটা সময় পর খুবই বিরক্ত লাগা শুরু করলো। সারাদিনই মা হয় ছোটভাইটাকে কিংবা মিট্টিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। একটা সময় পর আমার মনে হতে লাগলো, মা আমাকে আর ভালোবাসেন না। মিট্টিই তার সবকিছু!
একদিন দুপুরে মা ঘুমাচ্ছিলেন। আমি চুপি চুপি বিছানা থেকে উঠে খাঁচার দরজা খুলে মিট্টিকে বের করে আনলাম। এরপর রান্নাঘরের বটি দিয়ে কুচিকুচি করে কেটে একটা পলিথিনে ভরে পাঁচতলার বারান্দা দিয়ে ঝুপ করে নিচে ফেলে দিলাম। নিমিষেই কোত্থেকে তিন-চারটা কুকুর এসে পলিথিনটা ছিন্নভিন্ন করে মিট্টিকে ভাগাভাগি করে খেয়ে নিল। মহানিশ্চিন্ত আমি, কোথাও কোনো প্রমাণ রইলো না। আবার খুব সন্তর্পণে মায়ের পাশে যেয়ে শুয়ে পড়লাম, মহা শান্তির এক ঘুম দিলাম সেদিন! মায়ের ফোঁপানির আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গলো আমার। এরপর অনেকদিন মাকে একা একা নিরালায় কাঁদতে দেখেছি। মায়ের কান্না দেখলেই আমার ভেতরটা চনমন করে উঠতো, এক অজানা ভালো লাগায় ভরে যেত মনটা!
এরপর একবার বন্ধু মন্টুকে এমন কঠিন শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম যে ও নির্ঘাত আজীবন তা মনে রাখবে। ক্লাস এইটে ওঠার পর থেকে খেয়াল করলাম ষ্কুলের বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে টিচাররা পর্যন্ত মন্টুকে বেশী আদর-স্নেহ করে। আমি যে প্রতি বছর ক্লাসে ফার্ষ্ট হচ্ছি তার কোনো দামই নাই, দিনমজুরের ছেলে মন্টুই ওদের কাছে সবকিছু! বিশাল এক রগরগে প্রেমপত্র লিখলাম মন্টুর নামে, আর কায়দা করে তা ঢুকিয়ে দিলাম ওর ব্যাগে। আমি জানতাম সেদিন সবার ব্যাগ চেক করা হবে। মনে মনে এক অশান্ত আনন্দ খেলা করছিল সেই সকাল থেকে।
টিফিন পিরিয়ডের পর হেডস্যার তার ঐতিহাসিক চিকন বেতখানা দুলাতে দুলাতে সবাইকে মাঠে জড়ো করলেন। মন্টুর ব্যাগ সার্চ করা মাত্রই চিঠিটা বের হয়ে আসলো। মাঠভর্তি ছেলেমেয়ে আর টিচারদের সামনে মন্টুকে বেধড়ক পেটালেন হেডস্যার। মন্টু একটা শব্দও করলো না, নির্বিকারভাবে মার খেয়ে গেল। ষ্কুল ছুটির সময় শুধু দেখতে পেলাম ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে আছে। আচ্ছা, ও কি টের পেয়েছিল কাজটা কে করেছে! এরপর আর ওকে ষ্কুলে দেখি নাই। পরে শুনেছিলাম এলাকা ছেড়েই চলে গেছে পুরো পরিবার। মন্টুরও নাকি আর লেখাপড়া করা হয়ে ওঠেনি! কলেজে উঠলাম।
আমাদের বাংলা পড়াতেন আশা ম্যাডাম। দেখে মনে হত রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে উঠে আসা কোনো নারী চরিত্র। তাঁতের শাড়ি পড়ে লম্বা বেনী দুলিয়ে যখন ক্লাসরুমের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে ‘হৈমন্তী’ পড়াতেন, তখন আমি মনে মনে কোন সুদূরে হারিয়ে যেতাম। খেয়াল করলাম কলেজ ছুটির পর প্রায় প্রতিদিনই ফয়েজ স্যারের সাথে এক রিকশায় কোথায় যেন যান উনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেল দু’জনের মধ্যে মন দেয়া-নেয়া জাতীয় কিছু একটা চলছে। আমার আর সইলো না!
ফয়েজ স্যার বরাবরের মতো কেমিষ্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে আমাদের বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝাচ্ছিলেন। হঠাৎ আশা ম্যাডামকে দেখতে পেয়ে উনি ল্যাব থেকে বের হয়ে গেলেন। বিদ্যুতের গতিতে আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল! কিসের সাথে কি যেন মিশিয়ে দিলাম, মুহুর্তেই পুরো ল্যাবে আগুন লেগে গেল। চারিদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। সেদিন আমিও অনেকটা প্রাণ হাতে নিয়ে সরতে পেরেছিলাম। এতো বড় দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে ফয়েজ স্যার চাকরি হারালেন। পরে শুনলাম আশা ম্যাডামেরও কার সাথে যেন বিয়ে হয়ে গেছে, উনিও চাকরি ছেড়ে স্বামীর সাথে বিদেশ চলে গেলেন। আমি তখন আত্মতৃপ্ত এক মানুষ!
আচ্ছা, ইউনিভার্সিটি লাইফের কাহিনিটা এখানে বলা কি ঠিক হবে? সেটা তো আরও ভয়ংকর! নাহ, আজ বলবো না। তবে এখন যা ঘটতে যাচ্ছি তা হয়তো ইউনিভার্সিটির সেই কাহিনিকেও হার মানাবে।
গত কয়েকদিন ধরে এক তীব্র মানসিক যন্ত্রণা আমাকে ঘিরে ধরেছে। একটা একটা করে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে পড়ছে আর নিজেকে মনে হচ্ছে মানসিকভাবে ভয়াবহ বিকলাংগ এক মানুষ আমি! এই বিকলাংগতার কারণে হারিয়েছি আমার স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে। যদিও কেউ জানে না এজন্য আমিই যে দায়ী!
আমার মিষ্টি হাসি, আমার ভালো ব্যবহার, আমার বদান্যতার জন্য দেশের উচ্চপর্যায় থেকে বিশাল এক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে আজ। কিন্তু নিজের এই সাফল্যও আমার নিজের সহ্য হচ্ছে না। ভয়ংকর একটা হিংসা আমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমার চেয়ে আমি ভালো হতে পারি না!
ঠিক এই মুহুর্তের জন্যই যেন এতোদিন অপেক্ষা করছিলাম। এটা নিশ্চিত, এখন আমি যা ঘটাতে যাচ্ছি তা আজীবন সবার মনে থাকবে। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়বে আমার চরম ঘৃণ্য এই বর্বর মানসিকতার কথা!
(ইহা একটি উর্বর মস্তিষ্কের প্রলাপমাত্র। কোনো ব্যক্তি কিংবা চরিত্রের সাথে মিলে গেলে লেখক কোনোভাবেই দায়ী নয়)!