ঢাকা (ভোর ৫:৩৬) বুধবার, ২৭শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সাকার ফিশের কারণে হুমকিতে দেশি মাছ

অন্যান্য ২৩৯১ বার পঠিত

নিজস্ব প্রতিনিধি নিজস্ব প্রতিনিধি Clock মঙ্গলবার দুপুর ০৩:৫৩, ২১ ডিসেম্বর, ২০২১

দেশের সব ধরনের জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়েছে কালছে কাঁটাযুক্ত মাছ ‘সাকার’। অ্যাকুয়ারিয়ামের শোভাবর্ধক ও আবর্জনাভুক এই মাছটি এখন দেশি মাছের জন্য হুমকি। দ্রুত বংশ বিস্তারের মাধ্যমে এরা দখল করছে অন্য মাছের আবাসস্থল। উন্মুক্ত জলাশয়ের মাছের ডিম ও নিচের শ্যাওলা-আবর্জনা খেয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে খাদ্যশৃঙ্খলে। খাবার হিসেবে অত্যন্ত নিম্নমানের এই মাছ দ্রুত বংশ বিস্তার করে দখল নিচ্ছে জলাশয়ের। জেলেরা মাটিতে পুঁতে ফেলেও কমাতে পারছেন না বিস্তার। সরকারিভাবেও নেওয়া হচ্ছে পদক্ষেপ।

জানা যায়, দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অববাহিকার সিলারিফর্মস (Siluriformes) বর্গের লোরিকারিডাই (Loricaridae) পরিবারের সাকার মাছের প্রজাতিগুলোর মধ্যে সাকার মাউথ ক্যাটফিশ (Sucker Mouth Catfish) এবং সেইলফিন ক্যাটফিশ (Sailfin Catfish) বৈজ্ঞানিক নাম যথাক্রমে হাইপোসটোমাস প্লিকোসটোমাস (Hypostomus plecostomus) এবং পিটারিগোপ্লিসথিস পারডালিস (Pterygoplichthys pardalis) প্রজাতি দুটি এদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। আমাদের দেশে ‘সাকার’, ‘প্লেকো’ এবং স্থানীয়ভাবে ‘চগবগে’ নামেও পরিচিত। মাছটি বর্তমানে উন্মুক্ত জলাশয় ও চাষের পুকুরে পাওয়া যাচ্ছে, যা উদ্বেগজনক। স্বাদু পানির এ মাছটি শ্যাওলা পরিষ্কারক বাহারি মাছ হিসেবে সাধারণত অ্যাকুরিয়ামে ব্যবহার করা হয়।

মৎস্য সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০০১ বা ২০০২ সালের দিকে ইউরোপের এক কূটনীতিক মেয়াদ শেষে চলে যাওয়ার আগে ঢাকার গুলশান লেকে কয়েকটি সাকার মাছ ছেড়ে দেন। এরপর সেখান থেকেই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এটি। বাংলাদেশে প্রাপ্ত সাকার ফিশ ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। এটি পানি ছাড়াই প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মৎস্য আইন ২০১১ অনুযায়ী বাংলাদেশে দেশীয় প্রজাতির মাছের ক্ষতি করে এমন যে কোনো বিদেশি মাছ আমদানি ও চাষ দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে নানা উদ্যোগ নিলেও সহসা এই মাছ বিলুপ্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

জেলেরা জানান, বুড়িগঙ্গাসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে জাল ফেললে দেশীয় মাছের চেয়ে সাকার মাছই বেশি উঠছে। এসব মাছ পেলে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়। অন্যথায় এসব মাছ আবার অন্য মাছের ডিম খেয়ে ফেলে, আর দেশীয় মাছ ধ্বংস করে। দ্রুত এ সমস্যা সমাধান না হলে সাকার মাছের সংখ্যা আরও বাড়বে।

সাকার মাছের বৈশিষ্ট্য
# দেহ অস্থিযুক্ত বর্মের ন্যায়, বহিরাবরণ কাঁটাযুক্ত, কালো মোজাইক রং ও সাকিং ডিস্কযুক্ত মুখ নিম্নমুখী।

# প্রজননকাল মার্চ থেকে সেপ্টেম্ব, তবে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ। স্ত্রী মাছ ৫০০ থেকে ৩ হাজার ডিম পাড়ে।

# রেণু সাঁতার কাটা পর্যন্ত বাবা মায়ের কাছে থাকে, অ্যাকটিভ প্যারেন্টাল কেয়ার (Active parental care) বিদ্যমান।

# স্বল্পমাত্রার অক্সিজেনযুক্ত পরিবেশে বাঁচতে পারে।

# খাবার মাছ হিসেবে এ মাছের খাদ্যমান নিম্নস্তরে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ সাধারণত এটি খায়।

ক্ষতিকর প্রভাব
# দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে বিধায় উন্মুক্ত জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশবৃদ্ধি ও প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

# দেশীয় প্রজাতির মাছের সঙ্গে খাদ্য ও পরিবেশ নিয়ে প্রতিযোগিতা করে।

# এ মাছটি দ্রুত বংশবৃদ্ধিতে সক্ষম বলে জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে জলাশয়ের পাড়ে ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত গর্ত তৈরি করে তা ধ্বংস করে।

# দেশীয় প্রজাতির মাছের ডিম ও রেণু ভক্ষণ করে মাছের বংশ বিস্তারে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

# জলাশয়ের তলার শ্যাওলা ও জৈব আবর্জনা খায় বিধায় জলজ পরিবেশের সহনশীল খাদ্যশৃঙ্খলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

# সাকার মাছের সঙ্গে স্বল্পায়ু, তৃণভোজী, খরাকাতর দেশীয় মাছের অসম প্রতিযোগিতা হয় বলে দেশীয় মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানাবিধ ক্ষতি করে।

গৃহীত পদক্ষেপ
মাছটি যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া, চাষের জলাশয়ে পাওয়া গেলে তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে বিনষ্ট করার মাধ্যমে মৎস্যচাষি, মৎস্যজীবীসহ সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মাঠ পর্যায়ের দপ্তরগুলোতে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

একজন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা লেভেলের কর্মকর্তাসহ দুই সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনপূর্বক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

মাঠপর্যায়ে সাকার মাছ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, যাচাই, হ্যাচারিগুলো পরিদর্শন ও হ্যাচারি মালিকদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে কমিটি একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিল করে।

সাকার মাছ নিয়ে করণীয়
গত ৬ ডিসেম্বর মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালকরা, উপ-পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বৈঠক হয়। যেখানে বেশকিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

সিদ্ধান্তগুলো হলো- এ মাছটি যাতে কোনোভাবেই উন্মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে মনিটরিং, চাষ ও উন্মুক্ত জলাশয়ে পাওয়া গেলে তা জলাশয়ে ছেড়ে না দিয়ে বিনষ্ট করা।

*পুকুর, দিঘি বা চাষের জলাশয় শুকিয়ে বা সেচের মাধ্যমে এ মাছ সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে চাষিদের উৎসাহিতকরণ।

* আফ্রিকান মাগুর, পিরানহা মাছের মতো মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৮৫’ তে এ সম্পর্কে বিধি সংযোজন করে এ মাছের বিষয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া।

*শোভাবর্ধনকারী মাছ হিসেবে বাজারজাতকরণের জন্য হ্যাচারিতে প্রজনন বা লালন-পালন বন্ধ করা।

*জেলা-উপজেলাসহ সংশ্লিষ্ট স্থানে লিফলেট বিতরণ, বিটিভিসহ অন্য টেলিভিশন চ্যানেল, বেতার ও পত্র-পত্রিকায় ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে মৎস্যচাষি, মৎস্যজীবীসহ সবাইকে উদ্বুদ্ধকরণ ও জনসচেতনতা বাড়াতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া।

*পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে এ মাছের ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণ ও মাছের বিস্তাররোধে সচেতনতা বাড়ানো।

* বিমান ও স্থলবন্দরের মাধ্যমে এ মাছের কোনো আমদানি যাতে না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ।

এ বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (গ্রেড-১) কাজী শামস আফরোজ বলেন, বেশ কিছুদিন আগেও আমরা মাঠ পর্যায়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম, সেই আলোকে কাজ চলছিল। সম্প্রতি আমরা আরও একটি চিঠি দিয়েছি যে, দুই রকম জলাশয়- একটি হলো ক্লোজ ওয়াটার যেটি আমরা কালচার করি। আরেকটি হলো ওপেন ওয়াটার। ক্লোজ ওয়াটারে এ ধরনের মাছ ধরা পড়লে আমরা সেটি ধ্বংস করি। পাশাপাশি সেই পুকুরটা সেচে নতুন করে ট্রিটমেন্ট দিয়ে সাকার মাছের কোনো রকম কিছু না থাকে সবকিছু ধ্বংস করে তারপর মাছ চাষের আওতায় আসবে। ওপেন ওয়াটারের জন্য আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করতে হচ্ছে।

‘বুড়িগঙ্গায় যে সাকার মাছ আমাদের পাওয়া গেছে, সেখানে আমরা একটা টিম পাঠিয়েছিলাম। সেখানে যে লোকাল কমিউনিটি, মৎস্যজীবী ও অফিসাররা আছেন তাদের নিয়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা হয়েছে। কীভাবে এটি পাওয়া গেলো, কীভাবে এটা ধ্বংস করা হবে, সেই পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেছেন। আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসে যাতে এটা একেবারেই বন্ধ করতে পারি, এখন যেটা বিদেশ থেকে আসে আমদানি হয় এবং যেটা হ্যাচারিতে হচ্ছে সেগুলো আমরা টোটালি বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছি।’

তিনি আরও বলেন, এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কারণ এখানে কালচারে সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই এটা করতে পারবো। যেটা ওপেন ওয়াটারে গেছে সেটা ধ্বংস করতে একটু সময় লাগবে। এটার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া করা লাগবে বিধায় বাড়তি সময় লাগতে পারে। এটা কর্মসূচির মাধ্যমেই করতে হবে।




শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

মেঘনা নিউজ-এ যোগ দিন

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর



© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT