যেসব সম্পদের ওপর যাকাত ফরজ
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী বৃহস্পতিবার রাত ০১:৫৭, ২৯ এপ্রিল, ২০২১
জাকাত ইসলামি অর্থব্যবস্থার অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ঈমান আনা ও নামাজ আদায়ের পর জাকাত নিয়মিত আদায় করেই একজন বিত্তবান ব্যক্তি মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন।
এখানে জাকাত সংক্রান্ত কিছু জরুরি মাসয়ালা উল্লেখ করা হলো-
মাসয়ালা: প্রাপ্তবয়স্ক এবং বুদ্ধি-জ্ঞানসম্পন্ন মুসলমানের (নারী-পুরুষ) মালের ওপর কিছু শর্তসাপেক্ষে জাকাত ফরজ করা হয়েছে। যেসব শর্তসাপেক্ষে উপরোক্ত ব্যক্তির মালের ওপর জাকাত ধার্য হয় তা হলো-
১. মালের ওপর পূর্ণ একটি (চান্দ্র) বছর তার পূর্ণ মালিকানা বিদ্যমান থাকতে হবে।
২. মাল এমন প্রকৃতির হতে হবে যার ওপর জাকাত ধার্য হতে পারে।
৩. মাল নিসাব পরিমাণ বা নিসাবের মূল্যের সমপরিমাণ হতে হবে।
৪. ওই নিসাব পরিমাণ মাল তার মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে।
মালিকানা বলতে, ‘কোনো বস্তু ও ব্যক্তির মধ্যকার শরিয়াসম্মত যোগসূত্রকে বুঝায়, যা ব্যক্তিকে ওই বস্তু নিঃশর্তভাবে ভোগ ব্যবহারের অধিকার দেয় এবং অপর লোকের হস্তক্ষেপে বাধা দেয়।
নগদ অর্থ, সোনা-রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য, পালিত পশু, কৃষিজ পণ্য ইত্যাদির ওপর জাকাত ধার্য হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি, সরকারি সম্পত্তি, নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস, বাড়িঘর ইত্যাদির ওপর জাকাত ধার্য হয় না।
কৃষিজ ফসল, ফলমূল ইত্যাদির ক্ষেত্রে পূর্ণ এক বছর মালিকের দখলে থাকা শর্ত নয়। তা যখন আহরিত হয় তখন তার ওপর জাকাত (উশর) ধার্য হয়।
সম্পদের চল্লিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত হিসেবে প্রদান করতে হবে। এ হিসেবে অতিরিক্ত মালের ওপরও জাকাত ফরজ হবে। জাকাত নগদ অর্থ দ্বারাও পরিশোধ করা যায় এবং সংশ্লিষ্ট মাল দ্বারাও পরিশোধ করা যায়।
মাসয়ালা: স্বর্ণ, রূপা ও ক্যাশ টাকা নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর তা নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ হতে অতিরিক্ত হওয়া জাকাত ফরজ হওয়ার মৌলিক শর্ত। সুতরাং মালিকানাধীন জমি, বসবাসের বাড়ি ও চলাফেরার বাহন-গাড়ি ইত্যাদির ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে না। বিক্রয়ের উদ্দেশ্য ছাড়া ক্রয়কৃত জমির ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/৩০৩
মাসয়ালা: মহিলাদের ব্যবহৃত স্বর্ণ-রূপার অলংকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়, তাই শরিয়তের নির্দেশ অনুযায়ী সর্বাবস্থায় অলংকারের জাকাত প্রদান করা জরুরি। -সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১৫৬৩, আল বাহরুর রায়েক: ২/২২৬
মাসয়ালা: আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার সমমূল্যের হয়ে যায় তাহলেও তার উপর জাকাত ফরজ হবে। যেমন কারো নিকট কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপার মূল্যের সমান হয় তাহলে তার উপরও জাকাত ফরজ হবে। -রদ্দুল মুহতার: ৫/২১৯
মাসয়ালা: ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে নগদ টাকার জাকাত ওয়াজিব হওয়ার জন্য রূপার পাইকারি ক্রয়মূল্য ধর্তব্য নয়। বরং তার খুচরা বিক্রয়মূল্য অর্থাৎ বাজারদর হিসাবে ৫২.৫ তোলা রূপার যেই পরিমাণ টাকা আসে ওই পরিমাণ টাকা থাকলে জাকাত ওয়াজিব হবে। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৮০
মাসয়ালা: স্বর্ণে ব্যবহৃত খাদ স্বর্ণের তুলনায় কম হলে খাদ স্বর্ণের হিসেবে চলে যায় এবং খাদ ও স্বর্ণ একত্রে হিসাব করে জাকাত দিতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ২/৩০০
মাসয়ালা: ডায়মন্ড যদি ব্যবসার উদ্দেশ্যে না হয়, তাহলে তার ওপর জাকাত আসবে না। এমনিভাবে কোনো মহিলার শাড়ি চাই তা ব্যবহার হোক বা না হোক, জাকাত আসবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস: ১০০৬৭, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৮০
মাসয়ালা: বছরের মাঝে সম্পদ নিসাব থেকে কমে এলেও শুরু ও শেষে নিসাব পরিপূর্ণ থাকলে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং বছর শেষে যত টাকা হাতে থাকে তার ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৮৮
মাসয়ালা: যদি ব্যবসার নিয়তে জমি ক্রয় করে তাহলে প্রত্যেক বছর তার বাজারমূল্য হিসাবে জাকাত আদায় করতে হবে। অন্যথায় জাকাত আসবে না। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/২০
মাসয়ালা: ব্যবসার উদ্দেশ্য ছাড়া ক্রয়কৃত জমি ক্রয়ের পর বিক্রয়ের নিয়ত করলেও তার ওপর জাকাত আসবে না, কেননা ওই জমি ব্যবসার উদ্দেশ্যে খরিদ করা হয়নি। হ্যাঁ, বিক্রয়ের পর মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত আসবে। -মাবসুতে সারাখসি: ২/১৬৯, আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৭২
মাসয়ালা: জমির উৎপাদিত ফসলাদির ওপর সাধারণত উশর আসে, জাকাত আসে না। তাই উৎপাদিত ফসলাদি বছর শেষে অতিরিক্ত হলেও জাকাত দিতে হবে না। তবে সেগুলো বিক্রির টাকার সঙ্গে অন্যান্য জাকাতের সম্পদ থাকলে তার সঙ্গে মিলিয়ে নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দেওয়া জরুরি।
মাসয়ালা: খালি জায়গায় রোপণকৃত গাছের কোনো জাকাত দিতে হবে না। হ্যাঁ, বিক্রির পর তার মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বা সে মূল্য অন্য অর্থের সঙ্গে মিলে নিসাব পূর্ণ হলে জাকাত আদায় করতে হবে। -তাবঈনুল হাকায়েক: ১/২৯১
মাসয়ালা: নিজের ও পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে দোকানের মাল ও ব্যবসায়িক পণ্যের মূল্য নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত আদায় করা জরুরি হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/২০
মাসয়ালা: সর্বমোট হিসাব থেকে ঋণের পরিমাণ টাকা বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকা নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে। অন্যথায় জাকাত দিতে হবে না। -মুসান্নাফে আবদুর রাজ্জাক, হাদিস: ৭০৮৫
মাসয়ালা: নগদ টাকা ঋণ দিলে ওই টাকা নিসাব পরিমাণ হলে ঋণদাতাকে ওই টাকার জাকাত আদায় করতে হবে। ঋণের টাকা হাতে আসার পর বিগত বছরগুলোর জাকাত একসঙ্গে আদায় করবে। তবে টাকা হাতে আসার পূর্বে আদায় করলেও জাকাত আদায় হয়ে যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/১০
মাসয়ালা: কারখানা ও ফ্যাক্টরির মালিকের ওপর ফ্যাক্টরির মেশিন ও বিল্ডিংয়ের মূল্যের জাকাত আসবে না। এ ছাড়া উপাদান, কাঁচামাল ও যে সমস্ত মাল বাকিতে বিক্রি করা হয়েছে এবং তার মূল্য উসূল করাও সম্ভব এসব কিছুর সমষ্টি নিসাব পরিমাণ হলে তার ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে। -আদ্দুররুল মুখতার: ২/২৬৭, ফাতাওয়ায়ে উসমানি: ২/৩৯
মাসয়ালা: নিজের ব্যবহৃত বা ব্যবসার কাজে ব্যবহৃত হয় এমন গাড়ির মূল্যের ওপর জাকাত আসবে না। তবে এর মাধ্যমে উপার্জিত ভাড়ার টাকা জাকাতের মূল হিসাবের সঙ্গে যোগ করতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৫
মাসয়ালা: ভাড়া দেওয়া বাড়ি ও মার্কেটের মূল্যের ওপর জাকাত আসবে না। তবে এগুলো থেকে অর্জিত ভাড়া যদি নিসাব পরিমাণ হয় তাহলে বছরান্তে জাকাত আসবে। -ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ১/১৮০
মাসয়ালা: যে সমস্ত মালের জাকাত দেওয়া ওয়াজিব হওয়ার পরও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় জাকাত আদায় করেনি ওই মাল চুরি বা ধ্বংস হয়ে গেলে ওই সম্পদের জাকাত দিতে হবে না। তবে জাকাত আদায় করতে বিলম্ব করার গোনাহের জন্য তাওবা করা জরুরি। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৮৩, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/১৭০
মাসয়ালা: সমিতি ও ব্যাংকে জমাকৃত টাকা নিসাব পরিমাণ হলে বছরান্তে জাকাত ফরজ হতে থাকবে। সুদি ব্যাংকে জমাকৃত টাকার প্রাপ্ত সুদ সওয়াবের নিয়ত ব্যতিত সদকা করে দেওয়া ওয়াজিব, সুদের টাকার ওপর জাকাত ফরজ হয় না। -রদ্দুল মুহতার: ২/২৬৭
মাসয়ালা: প্রয়োজনীয় থাকার ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্যে জমাকৃত নিসাব পরিমাণ টাকার ওপর চন্দ্র বছর অতিবাহিত হলে নির্ভরযোগ্য মতানুসারে জাকাত ওয়াজিব হবে। তবে বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে ওই টাকা দ্বারা নির্মাণসামগ্রী ক্রয় করে নিলে এর ওপর জাকাত ফরয হবে না। -রদ্দুল মুহতার ২/২৬২