আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি মহব্বত করা মুমিনের কাজ!
আরিফুল ইসলাম বৃহস্পতিবার সকাল ১১:১০, ২৯ আগস্ট, ২০১৯
হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকীঃ ঈমান আকীদা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে হৃদয় উজাড় করে মহব্বত করা। নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ের ঊর্ধ্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে স্থান দেয়া এবং তাঁদেরকে সবচে বেশি মহব্বত করা। কেননা এর অন্যথা হলে কোনো মুমিন মুমিন হতে পারে না।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَجَعَلَ الظُّلُمَاتِ وَالنُّورَ، أَحْمَدُهُ سُبْحَانَهُ وَأُثْنِيْ عَلَيْهِ الْخَيْرَ كُلَّهُ، لَا أُحْصِيْ ثَنَاءً عَلَيْهِ وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُوْلُهُ بَعَثَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ بَشِيْراً وَنَذِيْراً، وَدَاعِياً إِلَيْهِ بِإِذْنِهِ وَسِرَاجاً مُنِيْراً، صَلَّىَ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَى آلِهِ الْأَطْهَارِ وَأَصْحَابِهِ الْأَبْرَارِ وَعَلَى سَائِرِ عِبَادِ اللهِ الصَّالِحِيْنَ الْأَخْيَارِ، أَمَّا بَعْدُ :
প্রিয় পাঠক বৃন্দকে ! আজ আমি আপনাদের সামনে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তা এমন একটি বিষয়, যা আমাদের সবারই প্রয়োজন এমন একটি বিষয়, যার উপস্থিতি ঈমানের এক অপরিহার্য শর্ত। বিষয়টি হলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে হৃদয় উজাড় করে মহব্বত করা। পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ের ঊর্ধ্বে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে স্থান দেয়া এবং তাঁদেরকে সবচে বেশি মহব্বত করা। কেননা এর অন্যথা হলে কোনো মুমিন মুমিন হতে পারে না। সূরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
{قُلْ إِنْ كَانَ آَبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ}
বল, তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের সে সম্পদ যা তোমরা অর্জন করেছ, আর সে ব্যবসা যার মন্দা হওয়ার আশঙ্কা তোমরা করছ এবং সে বাসস্থান, যা তোমরা পছন্দ করছ, যদি তোমাদের কাছে অধিক প্রিয় হয় আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করার চেয়ে, তবে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহ তাঁর নির্দেশ নিয়ে আসা পর্যন্ত। আর আল্লাহ ফাসিক সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সূরা আত-তাওবা:২৪)।
কাযী ইয়ায রহ, বলেন, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করা ফরজ সাব্যস্ত হওয়ার বিষয়ে দলীল ও প্রমাণস্বরূপ এই একটিমাত্র আয়াতই যথেষ্ট। কারণ এ আয়াতে ঐসব লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে দিয়েছেন যাদের কাছে নিজের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের চেয়ে বেশি প্রিয়। আর তোমরা অপেক্ষা করো আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্তশীর্ষক ঘোষণার মাধ্যমে তাদেরকে সাবধান করেছেন। অতঃপর আয়াতের শেষাংশে এ জাতীয় লোকদেরকে ফাসেকদের কাতারে শামিল করেছেন। আর জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা ঐ পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত যাদেরকে আল্লাহ হেদায়েত দান করেন না। (আশ-শিফা) ।
হাদীসে এসেছে :
(لَا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى أَكُونَ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ وَالِدِهِ وَوَلَدِهِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ )তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে সবচে প্রিয় হবো তার মা-বাবা, সন্তান-সন্তুতি এবং সকল মানুষ থেকে (বুখারী ও মুসলিম)।
উল্লিখিত আয়াত ও হাদীস দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত সকল মুহাব্বতের উর্ধ্বে রাখাও অত্যাবশ্যক। কারণ রাসূল আলাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, যে সবকিছু থেকে আমাকে বেশি মহব্বত না করবে সে মুমিন হতে পারবে না। এ থেকে বুঝা যায় যে, ঈমানের অস্তিত্বের জন্য আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত অত্যাবশ্যক। আর আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বত ছাড়া ঈমানের স্বাদও অনুভব করা সম্ভব হয় না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লাম ইরশাদ করেছেন :
(ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ، أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ)
তিনটি গুণ যার মাঝে থাকবে সে ঈমানের স্বাধ উপভোগ করতে পারবে : (১) আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল অন্য সবকিছু থেকে তার কাছে অধিক প্রিয় হওয়া (২) একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে কাউকে মহব্বত করা এবং (৩) ঈমান আনার পর কুফরে ফিরে যাওয়াটা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মত অপছন্দের হওয়া।
আজ আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই ! মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা এই যে, মানুষ যাকে ভালোবাসে তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো সম্পর্কে সে সচেতন থাকে। মহব্বত শুধু মুখে মুখে দাবি করার বিষয় নয়, বরং মুহাব্বতের পক্ষে দলীল পেশ করতে হয়। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে আমরা মহব্বত করি এটি একটি দাবি। এই দাবির পক্ষেও প্রমাণ পেশ করতে হবে। অন্যথায় এ দাবি অর্থহীন ও মিথ্যা বলে পরিগণিত হবে।
তাহলে এবার আসুন, দেখা যাক আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করার আলামতগুলো কি কি? উলামায়ে কেরাম কোরআন ও হাদীস অনুসন্ধান করে মুহাব্বতের আলামতগুলো বের করেছেন। এসব আলামতের মধ্যে একটি হলো, আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ ও আনুগত্য করা, রাসূলের আদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়িত করা এবং রাসূলের প্রতি বেশি বেশি দরূদ পাঠ করা। ইরশাদ হয়েছে :
{قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ .}
বল, যদি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর তাহলে আমার অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে মহব্বত করবেন এবং তোমাদের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন। আর আল্লাহ চিরক্ষমাশীল, পরমদয়ালু (আলে ইমরান : ৩১)।
কাযী ইয়ায বলেন: কোনো ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসলে সে তাকে প্রাধান্য দেয় তার পছন্দ-অপছন্দকে প্রাধান্য দেয়। অন্যথায় মুহাব্বতের দাবিতে সে মিথ্যাবাদী বলে বিবেচিত হবে। তাই সত্যিসত্যি যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মহব্বত করে, অবশ্যই তার আচার-আচরণে সে মুহাব্বতের আলামতও প্রকাশ পাবে। আর এসব আলমতের মধ্যে প্রধান হলো, রাসূলের অনুসরণ ও তাঁর সুন্নতের অনুসরণ, কথা ও কাজে তাঁর আনুগত্য করা। তাঁর নির্দেশসমূহ মেনে চলা এবং যেসব বিষয় থেকে তিনি নিষেধ করেছেন তা বর্জন করা। সুখ-দুঃখ, সচ্ছলতা-অসচ্ছলতা সর্বাবস্থায় তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে চলা। বল, যদি তোমরা আল্লাহকে মহব্বত কর তাহলে আমার ইত্তিবা কর। আল্লাহ তোমাদেরকে মহব্বত করবেন এ আয়াতটি এরই প্রমাণ বহন করে।
রাসূলের মুহাব্বতের আলামত হলো তিনি যে বিষয়গুলো বিধিবদ্ধ করেছেন প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার উপরে সেগুলোকে প্রাধান্য দেয়া। ইরশাদ হয়েছে :
{وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَى أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ}আর মুহাজিরদের আগমনের পূর্বে যারা মদীনাকে নিবাস হিসেবে গ্রহণ করেছিল এবং ঈমান এনেছিল (তাদের জন্যও এ সম্পদে অংশ রয়েছে), আর যারা তাদের কাছে হিজরত করে এসেছে তাদেরকে ভালবাসে। আর মুহাজরিদেরকে যা প্রদান করা হয়েছে তার জন্য এরা তাদের অন্তরে কোন ঈর্ষা অনুভব করে না। এবং নিজেদের অভাব থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ওপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। যাদের মনের কার্পণ্য থেকে রক্ষা করা হয়েছে, তারাই সফলকাম (সূরা আল হাশর:৯)।
আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে মহব্বত করার আলামত হলো তার দীনকে নুসরত করা, দীনের প্রতি আঘাত এলে তা প্রতিহত করা। তাঁর সুন্নত ও আদর্শের প্রতি আঘাত এলে তা প্রতিহত করা। রাসূলকে মুহাব্বতের আলামত হলো তাঁর উপর নাযিল হওয়া কোরআনুল কারীমের তিলাওয়াত মহব্বতের বিষয়ে পরিণত হওয়া। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে সাক্ষাতের শাওক বা আগ্রহ রাখা। অর্থাৎ সব সময় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। কারণ মৃত্যুর মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সাক্ষাত লাভ করতে পারে। আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকার অর্থ হলো আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জি অনুযায়ী জীবনযাপন করা। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল যাদেরকে মহব্বত করেন ও ভালোবাসেন তাদেরকে মহব্বত করা এবং যাদেরকে অপছন্দ করেন তাদেরকে অপছন্দ করা।