বর্ষাগীতি ও রবীন্দ্রনাথ – অধ্যাপক আব্দুস সহিদ খান
মোঃ ইবাদুর রহমান জাকির, সিলেট শুক্রবার ভোর ০৪:২৭, ৭ আগস্ট, ২০২০
“মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।”
কিন্তু সকল প্রাণের মতো এটা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্যেও ব্যর্থ চেষ্টা! কবি তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে অনন্তকাল হয়তো বেঁচে থাকবেন মানবের মাঝে, তবে শারিরিক ভাবে নয়। আজ ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ সনের (৭ই আগষ্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) এ’দিনে কবি তাঁর প্রতিভার শ্রেষ্ট উপাদান সমুহকে রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রবীন্দ্রনাথ কৈশোর হতেই গান লিখতেছেন,কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাবে’ গীতাঞ্জললি’ পর্ব হতেই গান- কবিতা নহে- তাঁর ভাবের বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে।আমি এখন কবির বর্ষার গানের দিকে আলোকপাত করতে চাই।
বর্ষার টাপুরটুপুর দিনে বর্ষার গান শোনার একটা অন্যরকম মোহমায়া আছে। বর্ষার সঙ্গে বাঙালি মনের মিতালি রবিঠাকুর ছাড়া কার গানেই বা এমন করে পাব। নবীন মেঘের সুর লাগে রবিকবির মনে। তাইতো তাঁর ভাবনা যত উতল হল অকারণে। রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গান আছে ২৮৩টি এবং তার মধ্যে ১১৫টি বর্ষার গান। কবি তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর—‘‘ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত।’’
কখনও রবীন্দ্রনাথ লেখেন,
‘‘আজ বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,
আকাশ-ভাঙা আকুলধারা কোথাও না ধরে।।’’
আবার কখনও লেখেন,
‘‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে
দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে
ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে’’
অঝোর শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে
মেঘ-অঁচলে নিলে ঘিরে
কখনও রবীন্দ্রনাথ,চা- আড্ডায় পৌঁছতে যেয়ে স্বকণ্ঠে গেয়ে ওঠেন—
‘‘যেতে যেতে একলা পথে নিবেছে মোর বাতি।
ঝড় এসেছে, ওরে, এ বার ঝড়কে পেলাম সাথি।।
গানটি যদিও পূজা পর্যায় স্থান পেয়েছে। কিন্তু এক ঘোর কালবৈশাখী বিকেলে, দিনুঠাকুরের ফরাসে বসে গানের বাকি কথাগুলো যখন লিখছিলেন বাইরে তখন কালবৈশাখী শেষে বৃষ্টির মুষলধারা।
রবীন্দ্রনাথ কোনও গান তখনই রচনা করে হয়তো তাতে সুরও দিয়েছেন। সেই সুরটি পাছে ভুলে যান, তাই দিনুঠাকুরকে শিখিয়ে দেবার জন্য বৃষ্টিতেই গায়ে লম্বা বর্ষাতি জড়িয়ে, ছাতা হাতে ছুটে গেছেন দিনুঠাকুরের দেহলি বাড়িতে।
‘‘ভ্রমর যেথা হয় বিভাগী
নিভৃত নীল পদ্ম লাগি’’
কখনও কবি উদ্ভাসিত হন
‘‘আজ যেমন করে গাইছে আকাশ
তেমনি করে গাও গো
আজ যেমন করে চাইছে আকাশ তেমনি করে চাও গো’’
কখনও কবি মুগ্ধ আর্তিতে লিখে রাখেন প্রেমময় ভাবনার কিছু কথন—
‘‘আজ নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে আমার ভাবনা যত উতল হল অকারণে’’
প্রকৃতি যখন রজঃস্বলা , ধবনীর বুক বাদল-বারি শুষে নিচ্ছে অপার মেদুরতায়। কবি বর্ষাকে আরও নিবিড় করে কাছে ডাকেন।
‘‘এসো হে এসো সজল ঘন বাদল বরিষণে
বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে জীবনে’’
কবি তাঁর প্রিয়কে বেঁধে রাখতে চান। সতত যেন সে ছেয়ে থাকে কবির সাথে, কবির একেবারে পাশটিতে। এমন যখন দিনেই কবি চান সে থাকুক—
‘‘বন্ধু রহো রহো সাথে
আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে’’
কবির শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম ‘বর্ষামঙ্গল’ উৎসব হয়েছিল, তখন গুরুদেব একাকী সেই শ্রাবণী পূর্ণিমায় শিশুবিভাগের নতুন গৃহে গেয়েছিলেন—
‘‘আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে’’
কবি যখন গানটি গাইছিলেন তখন নাকি বাইরেও অফুরান শ্রাবণধারা। ওই গানের মধ্যে কবি তাঁর তিনটি বর্ষার কবিতা, যথা ঝুলন, বর্ষামঙ্গল এবং নিরুপম পংক্তি মিলিয়ে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে বসে গুরুদেব ‘বর্ষামঙ্গল’ রচনা করেছিলেন, তার প্রথম কবিতা ‘বর্ষা’ যদিও জোড়াসাঁকোতে বসেই লেখা। ‘কাব্যগ্রন্থাবলীতে’ বর্ষা ‘‘বাদরবরখন, নীরদগরজন, বিজুলীচমকন ঘোর’’।
চমৎকার আবিলতায় আমরা এই ভাবেই আষাঢ় পেরিয়ে যাই। শ্রাবণ পেরিয়ে যাই। এমন কী ভরা ভাদর-ও। কবির লেখনী সচল থাকে—
‘‘মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো,
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে
হৃদয়গানে সজল ঘন নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে’’
শিলাইদহে পদ্মার বুকে বজরার ছাতে বর্ষার মাধুর্যে আকুল রবীন্দ্রনাথ তাঁর সদ্য লেখা একটি বর্ষার গানের কথা উল্লেখ করে শিলাইদহ থেকে ইন্দিরাকে পত্র লিখেছিলেন। সেই সদ্য রচিত গানটি ছিল—
‘‘ঝরঝর ঝরিষে বারিধারা
ফিরে বায়ু হাহাস্বরে জনহীন প্রান্তরে
অধীরা পদ্মা তরঙ্গ-আকুলা
নিবিড় নীরদগগনে
কবিগুরুর গানের বাণীতে কালজয়ী কত বর্ষার গান। ধৃষ্টিবিলাস ও বর্ষা বন্দনায় রোমান্টিক কবি বিরহকাতরতায় যেন লিখে রাখেন—
‘‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়’’
রবিঠাকুরের ধরনে বর্ষাবিলাস আধুনিক বাংলা গানে তেমন ভাবে এসেছে কি? তবে সেগুলি খানিক অন্য মেজাজে। কবিই তো পারেনই লিখতে
‘‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার পরাণসখা বন্ধু হে আমার’’……….।[প্রয়াণ দিবসে কবিকে শ্রদ্ধা ]