ঢাকা (রাত ১:৪৯) বৃহস্পতিবার, ২৮শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কাশেম বিলে কাটানো দুই দিন 

অন্যান্য ২৭৩৩ বার পঠিত

নিজস্ব প্রতিনিধি নিজস্ব প্রতিনিধি Clock শনিবার রাত ০১:১৯, ২ অক্টোবর, ২০২১

গন্তব্য সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার বড় পাঙ্গাসী ইউনিয়নের কাশেম বিলে।

আমার যাত্রা শুরু রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানা থেকে। বান্ধবী রাখির বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দান করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরেছিলাম ৷ ভেবেছিলাম দূরের পথ তাই সকাল সকাল বেরিয়ে পরবো কিন্তু হঠাৎ প্রখর বৃষ্টির আগমন। অনেকটা সময় বৃষ্টি  প্রকৃতিকে ভিজিয়ে ক্ষান্ত হলে বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেলো আমার।

আমার সাথে গোবিন্দগঞ্জে আব্দুল্লাহ হিমু ও তুষার যোগ দেয়ার কথা থাকলেও আমার বিলম্ব আর বৃষ্টির অনিশ্চয়তা দেখে ওদের আগেই যেতে বলেছিলাম। এর আগে ঢাকায় যাওয়ার পথে সিরাজগঞ্জের ফুড ভ্যালিতে যাত্রাবিরতির জন্য দাঁড়ানো ছাড়া সিরাজগঞ্জে যাওয়া হয়নি। তাই নতুন জায়গা দেখার জন্য অনেক উদগ্রীব ছিলাম।

অনেকদিন করোনার জন্য বাসায় থেকে সবকিছু কেমন পাংশে লাগছিলো। ব্যস্ত জীবনকে ঘরোয়া করে সবকিছু রংহীন মনে হয়েছিলো। তাই ভ্রমণ পিয়াসি মনে এই সুযোগ কোনভাবেই অবহেলা করা যাবেনা বলে তাগাদা দিয়েছিলো।

যাইহোক, মিঠাপুকুর থেকে বাসে চড়ে বগুড়ায় পৌঁছাতে প্রায় আড়ায় ঘন্টা লেগে গেলো। তারপর চারমাথায় গাড়ি পরিবর্তন করে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার গাড়িতে উঠে পরলাম। চারমাথা থেকে রেলগেটের দীর্ঘ জ্যাম পেরোতে প্রায় ৩০ মিনিটের বেশি লেগে গেলো। জ্যাম থেকে বেড়িয়ে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া যেতে যেতে সন্ধ্যা ৭ টা বেজে গেছে।

ও দিকে যশোর থেকে তন্নী, কুষ্টিয়া থেকে আশরাফুল আর চুয়াডাঙ্গা থেকে সাজন ও সিলভি আপু আমার সাথে উল্লাপাড়ায় যোগ দেয়ার কথা থাকলেও তারা আমার অনেক আগে পৌঁছায় এবং কাশেমবিলের উদ্দেশ্য রওনা হয়ে যায়। অপরিচিত জায়গা আর একাকী হওয়াও কিছুটা বিপাকে পড়তে হয়েছিলো আমার।

তবে উল্লাপাড়ায় পৌঁছে রাখির চাচাতো ভাই রানার পরামর্শে লাহেরি মোহনপুরের সিএনিজিতে উঠে পরেছিলাম। তবে ওরা গয়হাট্টা হয়ে কাশেম বিলে গিয়েছিলো। যদিও ২ দিক দিয়েই যাওয়া যায় কিন্তু সন্ধ্যা হওয়ায় আমাকে লাহেরি মোহনপুর হয়েই যেতে হয়েছিলো। কারণ সন্ধ্যার পর গয়হাট্টা থেকে কাশেমবিলে যাওয়ার জন্য ভ্যান পাওয়া অনেক কষ্টকর বলে অবহিত হয়েছিলাম।

সিএনজিতে করে মোহনপুর যেতে প্রায় ৮ টা বেজে গিয়েছিলো। তারপর একজন যাত্রী ও আর যাত্রাপথ শুনশান বলে কোন ভ্যানওয়ালা আমাকে কাশেমবিলে নিয়ে যেতে রাজি হচ্ছিলো না। তবে সবিশেষ, ৫ গুণ ভাড়া বেশি ভাড়া দেওয়ায় একজন ভ্যানওয়ালাকে রাজী করানো সম্ভব হয়েছিলো। তারপর ভ্যান চড়ে শেষ গন্তব্য কাশেম বিলের দিকে আগাচ্ছিলাম।

কিছুটা পথ যাওয়ার পর কাশেমবিল এরিয়ায় ঢুকে পরি। চারিদিকে শুধুই পানি আর মাঝ দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা। ভ্যানওয়ালা মামা বললেন আর কয়েকদিনের মধ্যে এই রাস্তাও পানিতে ডুবে যাবে।

জোসনা রাতে সুবিশাল বিলের মাঝ দিয়ে ভ্যানে চড়ে হালকা বাতাসে যেন প্রাণ ছুঁয়ে গেলো। সারাদিনের দীর্ঘ যাত্রার কষ্ট যেন এক নিমিষেই উধাও।

প্রায় ১০-২০ মিনিট ভ্যান যাত্রা শেষে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য কাশেম বিলে পৌঁছালাম। বিলের ঠিক মাঝে সুবিশাল একটি বট গাছ রয়েছে। বিকেল হলে সেখানে বিভিন্ন জায়গা হতে হাজার হাজার দর্শনার্থী ঘুরতে আসে।

আমি সেখানে পৌঁছানোর কয়েক মিনিট পরেই সাজন ও রাখির চাচাতো ভাই (যার সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো) রানা আমাকে এগিয়ে নিতে আসে। ভ্যান আর যাবেনা তাই হাটতে হয়েছিলো আরো কিছুটা পথ। রানার সাথে কথা হলো পুরো রাস্তা জুড়ে। প্রায় ১৫ মিনিট হাটার পর কাঙ্ক্ষিত বাসায় চলে এসেছিলাম।

যদিও হেঁটে আসতে অনেক বেগ পোহাতে হয়েছিলো কিন্তু রাস্তাগুলো বাড়ির কাছে এসে অনেক উঁচু হয়ে গেছে।

এখানকার প্রত্যেকটা বাড়ি বিল থেকে প্রায় ১৫ ফিট উঁচুতে করা হয়েছে। শুনেছি মাঝেমাঝে পানির ভয়াবহতায় এই ব্যবস্থা।

অনেকদিন পর সবার সাথে দেখা হয়ে গল্প-আড্ডায় রাতটা ভালোই কেটেছিলো। তবে পরেরদিন সকালটা ছিলো বেশ রোমাঞ্চকর। ঘুম থেকে উঠে উঠানে দাঁড়াতেই মন ভরে উঠলো, দু’চোখ যেদিকে যায় শুধু পানি আর পানি। বাড়ির চারদিকে পানি হওয়ায় অনুভুতি এমন ছিলো যেন, বিশাল সুমুদ্রের বুকে কোন এক দ্বীপে ঘুরতে এসেছি।

বিশাল বিলের মাঝে অবিরাম ছোট,মাঝারি এবং বড় ধরণের নৌকা চলাচল করছে। প্রতিদিন শতশত যাত্রী আসা যাওয়া করছে তাদের নিজ গন্তব্যে।

পরিকল্পনা করলাম বিকেলে বিল ভ্রমণে বেরিয়ে পরবো। আমি, আব্দুলাহ, তুষার আর সিলভি আপু একটি নৌকা ভাড়া করলাম। মুজিব সরকার নামের মাঝি মামা এই এলাকায় সম্পর্কে অনেক মজার মজার ঘটনা শুনালেন। তবে নৌকাই হচ্ছে তার জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম। জেনে অবাক হবে যে, এখানে প্রায় প্রত্যেকটি বাড়িতেই ২/১ টা করে নৌকা রয়েছে। তাদের কেউবা নিজস্ব পরিবহনের জন্য রেখেছেন কেউবা সেই নৌকা দিয়ে জীবিকা অর্জন করছেন।

পুরো বিকেল বিলের নিস্প্রভ আবহাওয়া আর পানির থইথই শব্দে ভালোই কেটে গেলো।

কোলাহল শহুরে জীবন থেকে এমন পরিবেশে এসে সবার মনে অন্যরকম আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। যদিও সেইদিন রাতেও আমরা আবার নৌকায় চড়ে বিলের মাঝে ঘুরেছিলাম আর গান গেয়েছিলাম।

পরের দিন বিয়ের দিনের দৃশ্য ছিলো আরো চমকপ্রদ। বিয়ের বর আর বরপক্ষ কনের বাসায় এসেছে নৌকায় চড়ে। সবাই বিলের পাড়ে দাঁড়িয়েই বরপক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম ।

যদিও ছোট বেলায় শুনেছিলাম, পূর্বে মানুষ নৌকা করেই বিয়ে করে নতুন বউ বাসায় নিয়ে আসতো। কিন্তু কখনো ভাবিনি একুশ শতকে এসেও এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হবে।

বিয়ের বাড়িতে পুরোটা সময় বেশ আনন্দে কেটেছিলো। বিয়ের বাড়ির আনন্দের কোলাহলে থেকেও বিকেলে আবার নৌকায় ঘোরবার প্রলোভনে ছুটে গিয়েছিলাম। এ যেন এক অন্যরকম ভালোলাগা। নদী ভালো লাগেনা এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বারবার যেন পিছু ডাকে এই সৌন্দর্য।

বিয়ের পর্ব তো শেষ। সবার কাছে বিদায় নিয়ে পরের দিন সকালে আমরা নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ি। রাসেদ ভাই আমাদের বড় একটা নৌকার ব্যস্ততা করে দিয়েছিলেন। তবে আসার দিন যে জায়গায় ভ্যান এসেছিলো;২ দিনেই সেই রাস্তা পানিতে ডুবে গিয়েছিলো। তাই আমাদের নৌকা নিয়ে ভিন্ন রাস্তায় আসতে হয়েছিলো। আর সেখান থেকে গয়হাট্টা হয়ে উল্লাপাড়া যে যার মত বাড়িতে ফিরেছিলাম। তবে শেষবারের মত আমরা আবার পুরো বিলটা একবার প্রদক্ষিণ করে নিতে ভুলিনি।

সব মিলিয়ে জীবনের অন্যতম সুন্দর ২ টি দিন অতিবাহিত হয়েছে কাশেমবিলে। সময় এবং সুযোগ হলে আবারো কখনো ছুটে যাবো কাশেম বিলের মনোরম সৌন্দর্য্যে অবগাহন করতে।


ফয়সাল মাহমুদ আল-মারজান 

শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ 

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়




শেয়ার করুন

GloboTroop Icon
পাঠকের মতামত

মেঘনা নিউজ-এ যোগ দিন

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর



© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT