কারেন্ট সুদে আটকা পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে গাইবান্ধার উপজেলার নাকাই হাটের অভাবী মানুষেরা
তারিক আল মুরশিদ,গাইবান্ধা শুক্রবার সন্ধ্যা ০৭:৩৫, ২৭ নভেম্বর, ২০২০
কারেন্ট জালে যেভাবে মাছ আটকা পড়ে, ঠিক সেভাবেই মানুষ ধরার ফাঁদ বানিয়েছে গাইবান্ধা উপজেলার দাদন ব্যবসায়ী মহাজনরা।তাদের সেই মানুষ ধরার ফাঁদের নাম কারেন্ট সুদ। সেই কারেন্ট সুদের ফাঁদে আটকা পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন অভাবী মানুষেরা। জুয়ার নেশার মতই কারেন্ট সুদের নেশা মানুষকে পথে বসাচ্ছে। একবার কেউ কারেন্ট সুদের ফাঁদে পড়লে তিনি সর্বশান্ত না হওয়া পর্যন্ত আর বের হতে পারেন না। এমনই এক মগের মুল্লুক কারেন্ট সুদের কারবারীদের স্বর্গরাজ্য নাকাই হাটের চালচিত্র উঠে এসেছে৷
কারেন্ট সুদ কাকে বলে ?
কারেন্ট শক লাগলে যেমন মানুষের সব রক্ত চুষে শেষ না করা পর্যন্ত ছাড়ে না,ঠিক তেমনি কারেন্ট সুদ মানুষকে সর্ব শান্ত না করে ছাড়ে না । এজন্যই এর নাম কারেন্ট সুদ। কারেন্ট সুদ মানে হাতে নাতে সুদ। ১ সপ্তাহ, ১ মাস কিংবা ১ বছর পর সুদ দিবেন তা নয়। সকালে টাকা নিবেন,সন্ধ্যায় সুদ দিবেন। তারই নাম কারেন্ট সুদ। ১ হাজার টাকার দৈনিক সুদ ৫০ টাকা। তার মানে সকালে ১ হাজার টাকা লোন নিলে সন্ধ্যায় সুদ দিতে হয় ৫০ টাকা। আপনি আসল ফেরত না দিলেও দৈনিক সুদের টাকা যে কোন ভাবেই শোধ করতে হয়। তা না হলে প্রতিদিন আসলের সঙ্গে যোগ হবে প্রতি হাজারে ৫০ টাকা।পরদিন এই সুদ আসলের আবার সুদ দিতে হবে। এই চক্রবৃদ্ধির কারেন্ট সুদের ফাঁদে একবার কেউ পড়লে সে আর বের হতে পারে না। কারেন্টের মত আটকে ধরে এই সুদের নেশা।এজন্যই এলাকার মানুষ আদর করে এই সুদের নাম নাম দিয়েছেন কারেন্ট সুদ।
কারেন্ট সুদের ব্যবসায়ী কারা ?
কারেন্ট সুদের ব্যবসায়ীরা সবাই সুদখোর কোটিপতি। দেহব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ডিজিটাল সাংবাদিকরাও এই কারেন্ট সুদের কারবারে জড়িত।এরা গাইবান্ধা জেলা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ও নাকাই হাটে নামে বে নামে দাদন ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন।গাইবান্ধায় ৭টি উপজেলাতেই এই কারেন্ট সুদের কারবারিদের নেটওয়ার্ক আছে। এই সিন্ডিকেটের এতোটাই প্রভাব যে সেখানে অন্যকারো নাক গলানোর কোন সুযোগ নেই।তাই প্রশাসন থেকে শুরু করে সমাজের নেতা ফেতা সবাইকে তারা ম্যানেজ করে চলেন। কাজেই কথা বলার কেউ নেই। মানুষকে সর্বশান্ত করারও কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা নেই। ভুক্তভোগীরা কেউ কোন কথাই বলতে চান না। কারেন্ট সুদের ফাঁদে পড়ে কয়েকজন আত্মহত্যা করলেও সেই তথ্য চেপে যাচ্ছেন স্বজনরা।ফলে কারেন্ট সুদের শেকড়ের তালাশ করতে গিয়ে সহজেই সব কিছু পাওয়া যায় না।
নিজেরা এবং পরিবারের সদস্যদের নাম দিয়ে সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে সুদের ব্যবসা। তাদের সুদের হার প্রতি হাজারে প্রতিদিন ৫০ টাকা। এক দিন বা এক সপ্তাহ কেউ ঐ সুদের টাকা না দিতে পারলে মুল টাকার সাথে সুদের টাকা যোগ হয়ে সুদের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
যেভাবে চলে কারেন্ট সুদের কারবার
কারেন্ট সুদের নিয়মকানুনও একেবারে ফোর ফোরটি কারেন্টের মত। কেউ মাসিক হারে তাদের কাছে থেকে সুদের টাকা নিতে গেলে তাকে দিতে হবে ফাঁকা চেক এবং ২০০ থেকে ৩০০ টাকার ননজুডিসিয়াল ষ্ট্যাম্প। পরবর্তীতে যাতে ঐসব স্ট্যাম্পে নিজের ইচ্ছামত টাকার পরিমান বসিয়ে স্ব স্ব ব্যাংক থেকে চেক ডিজ অনার করে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
সঞ্চয় সমিতির আড়ালে কারেন্ট সুদের ব্যবসা:-
গোবিন্দ গঞ্জ উপজেলার নাকাই হাটের দাদন ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষকে সর্বশান্ত করছে নানা উপায়ে। এলাকায় বিভিন্ন নামে বেনামে সঞ্চয় সমিতি গড়ে তুলে তার আড়ালে কারেন্ট সুদের ব্যবসা করছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে মোটা অংকের লাভ প্রদানের কথা বলে সঞ্চয় রাখতে উদবুদ্ধু করে।
টাকার হিসাব,হিসাবের টাকা:-
দৈনিক সঞ্চয় জমাদানের ভিত্তিতে এলাকার ব্যবসায়ীদের এক বছর মেয়াদী সদস্য করে নিয়ে তাদের কাছ থেকে দৈনিক ১০/২০/৫০/১০০/২০০/৫০০/ টাকা হারে সঞ্চয় উঠানো হয়। সেই টাকা আবার ব্যবসায়ী বা অন্যান্য ব্যক্তিদের মাঝে কারেন্ট সুদে প্রদান করা হয়। কয়েক বছরে সাধারণ মানুষের কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পলাতক রয়েছে অনেকেই। তবু এদের দৌরাত্য বন্ধ হচ্ছে না।
কারেন্ট সুদে সংসার ভেঙ্গে যাওয়া এবং সুদের বোঝা টানতে না পেরে আত্মহত্যার মত কয়েকটি হৃদয়বিদারক ঘটনাও আছে। এই ঘটনাগুলোর তথ্য জানার জন্য অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।