চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে মাহি কান্ডে তৃণমূল আওয়ামীলীগে ক্ষোভ
এস এম সাখাওয়াত জামিল দোলন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ শনিবার দুপুর ০১:৪৯, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২
মাস দুয়েক আগেও রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানিয়ে সেই এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক কাজে অংশগ্রহণ ও গণসংযোগ শুরু করেন চিত্র নায়িকা মাহিয়া মাহি। কিন্তু হঠাৎ করেই গত সোমবার (২৬ ডিসেম্বর) থেকে বিএনপির এমপি আমিনুল ইসলামের পদত্যাগের পর শূন্য হওয়া চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনের উপ-নির্বাচনে গণসংযোগ ও পথসভা শুরু করেন মাহি। এ সময় নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশা ও ভোট চেয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি।
মাহির এমন কান্ডে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনের তৃণমূল আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। হটাৎ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে সক্রিয় হওয়ায় তা ভালো চোখে দেখছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, আসন্ন ১ ফেব্রুয়ারী উপ-নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকেই দেয়া হোক নৌকার মনোনয়ন।
মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গোমস্তাপুর উপজেলা ও রহনপুর পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগ করেছেন মাহিয়া মাহি। এ সময় মাহির সাথে উপস্থিত ছিলেন, তার স্বামী ও আওয়ামীলীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য রাকিব সরকার। গনসংযোগে তিনি নৌকার পক্ষে ভোট প্রার্থনা করেন।
হঠাৎ করেই মাহিয়া মাহির মনোনয়ন প্রত্যাশায় সক্রিয় হওয়া নিয়ে নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, দেশের ইতিহাসে আওয়ামীলীগ একটি প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল। তাই এ দলের পক্ষে যে কেউই মনোনয়ন চাইতে পারেন। আমরা আশা করি, আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিশ্চয় রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বিচার বিশ্লেষণ করেই নৌকার মনোনয়ন দিবেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা চাই, দূর্দিনে যেসব ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, দলকে সংগঠিত করেছেন, এমন একজন নেতাকেই মনোনয়ন দেয়া হবে। মাহিয়া মাহির সাথে স্থানীয় তৃণমূল নেতাকর্মীদের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি যেমন আমাদের কাউকে চেনেন না, তেমনি আমরাও তাকে কখনো রাজনীতির মাঠে দেখিনি। নির্বাচনের এক মাস আগে হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়েছেন তিনি।
রহনপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল আজিজ জানান, মাহিয়া মাহির সাথে আওয়ামীলীগ বা সহযোগী কোন সংগঠনের সম্পর্ক নেই। পৌর বা ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের কোন নেতাকর্মীকে তিনি চেনেন না। কর্মী বান্ধব আওয়ামীলীগ নেতার হাতে আমরা নৌকার মনোনয়ন দেখতে চাই। আমরা মাহির সাথে নেই। যেসব নেতা আমাদের পাশে ছিল, আমরাও তাদের সাথে আছি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নাচোল উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক সদস্য বলেন, ভোটের মাত্র এক মাস আগে এলাকায় এসে হাস্যরস ছাড়া আর কিছুই না। আর তাই যারা আওয়ামী লীগের দূর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে ত্যাগ স্বীকার করে দলকে সংঘটিত করে তাদের ছাড়া রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কাউকে মনোনয়ন দেয়া আওয়ামী লীগের জন্য বিপদ সংকেত হিসেবেই আমরা মনে করি। এখানে অনেকেই রয়েছেন, যারা নিজ নিজ কর্মগুণে দলে সক্রিয় অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। আশা করি, তাদের মধ্যেই কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে।
এ বিষয়ে নাচোল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের জানান, মানুষ রাজনীতিকে আলু-পটলের মতো পন্য মনে করছে। যেটা ইচ্ছে হলে বাজারে গিয়ে কিনে নেয়া যায়। রাজনীতিকে তেমনটা মনে করা উচিত নয়। এমনটা হলে রাজনীতিবিদদের রাজনীতি করার দরকার নাই। রাজনীতি করার একটি সুষ্ঠু প্রক্রিয়া রয়েছে। তা অনুসরণ করে মাহিয়া মাহি আওয়ামীলীগে আসার পর এসব কর্মকান্ড করলে তা মানানসই ছিল। যেসব ব্যক্তি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় তাদেরকে নৌকার মনোনয়ন দিলে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করব।
গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে যে কারো নৌকার মনোনয়ন চাওয়া গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। মাহির গণসংযোগ ও পথসভা শুরুর পর থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা আমাদেরকে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এনিয়ে তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
এনিয়ে কথা বলতে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুহা. জিয়াউর রহমানের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব মো. রুহুল আমিন মুঠোফোনে বলেন, নৌকার মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর উপর নির্ভর করে। তিনি যাকে মনোনয়ন দিবেন আমরা তার পক্ষেই কাজ করব।
এনিয়ে মাহিয়া মাহির স্বামী রাকিব সরকার মুঠোফোনে বলেন, এই মুহুর্তে কথা বলা সম্ভব নয়। একটি গণসংযোগে ব্যস্ত রয়েছি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসনে নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে রয়েছেন আওয়ামীলীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের অন্তত এক ডজনের অধিক নেতা। মাহিয়া মাহি ছাড়াও এদের মধ্যে রয়েছেন- জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও এই আসনের সাবেক এমপি মুহা. জিয়াউর রহমান, গোমস্তাপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাবেক এমপি গোলাম মোস্তফা, রাজশাহী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী সরকার, যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল আলম সৈকত জোয়ার্দ্দার, ভোলাহাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ, আওয়ামীলীগ নেতা খুরশিদ আলম বাচ্চু, কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা কামরুল হাসান লিংকন, নাচোল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল কাদের, জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হালিমা বেগম, গোমস্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন, গোমস্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ন রেজা, ভোলাহাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাব্বুল হোসেন এবং সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট শওকত আরা।
কিছু দিন আগেই তিনি ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং রাজশাহী বিভাগের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন।
বিএনপির এমপি আমিনুল ইসলামের পদত্যাগের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ শূণ্য আসনের উপ-নির্বাচনে অংশ নিতে ২৯ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছেন বলে জানান দেশের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহি।
উল্লেখ্য, গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির সাত সংসদ সদস্য। এতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (নাচোল-গোমস্তাপুর-ভোলাহাট) আসন শূন্য ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। গত ১১ ডিসেম্বর সংসদের স্পিকারের নিকট বিএনপি দলীয় ৬ জন সংসদ সদস্য পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরের দিন জাতীয় সংসদ সচিবালয় থেকে তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। ফলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থেকেই নির্বাচন কমিশন দেশের ছয়টি আসনে উপ-নির্বাচন ঘোষণা করে ১ ফেব্রুয়ারি।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে বিএনপি মনোনীত সংসদ সদস্য আমিনুল ইসলাম ধানের শীষ প্রতীকে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১ লক্ষ ৭৫ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী জিয়াউর রহমান নৌকা প্রতীকে ১ লক্ষ ৩৯ হাজার ৯৫২ ভোট পেয়ে হেরে যান। এবার আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করায় উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হতে যাচ্ছেন মাহিয়া মাহি।