টানা দরপতনে পতনে বাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা
মেঘনা নিউজ ডেস্ক রবিবার সকাল ১১:৪৩, ১৯ মে, ২০২৪
শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরছে না। টানা দরপতনে বাজার ছাড়ছেন বিনিয়োগকারীরা। গত সপ্তাহে পাঁচ কার্যদিবসেই সূচকের পতনে লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে দেশের প্রধান শেয়ার বাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে এসেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নানা উদ্যেগেও পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। কিন্তু কেন এ অবস্থা?
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের শেয়ার বাজারের সবচেয়ে বড় সমস্যা শেয়ার নিয়ে কারসাজি। গত সপ্তাহে টানা দরপতনের মধ্যেও ডিএসইতে মূল্যবৃদ্ধির শীর্ষে থাকা বেশির ভাগ কোম্পানিই ছিল কারসাজির শেয়ার। অথচ এ সময়ে ফান্ডামেন্টালি স্ট্রং অনেক ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ারদর কমে তলানিতে এসে ঠেকেছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, তাহলে কীভাবে বাজার নিয়ে আস্থা থাকবে বিনিয়োগকারীদের? এছাড়া দীর্ঘদিন বাজারে কোনো ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে না। যেসব কোম্পানি বাজারে নতুন বিনিয়োগকারী নিয়ে আসবে। তারা বলেন, বাজারে এমন সব কোম্পানি তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে, যেসব কোম্পানি বছর না ঘুরতেই লোকসান গুনছে?
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দীর্ঘদিন বাজার ফ্লোরপ্রাইসে আটকে ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ফ্লোরপ্রাইস তুলে দেওয়া হলেও এখন আবার শেয়ারের দাম কমার সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তারপরও বাজারে শেয়ারের দরপতন রোধ করা যাচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজের প্রধান নির্বাহী বলেন, বাজারের মন্দা অবস্থার মধ্যেই আগামী বাজেটে মূলধনি মুনাফার ওপর সরকারের করারোপের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাজার নিয়ে আস্থাহীনতা কাজ করছে।
শেয়ার বাজারের বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শেয়ার ধারণকারী প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের তথ্য বলছে, গত দুই সপ্তাহে ৭ হাজার ৫৪৩ জন বিনিয়োগকারী তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে বাজার ছেড়েছেন। তার বিপরীতে ২ হাজার ১২৬ জন বিনিয়োগকারী নতুন করে বাজারে যুক্ত হয়েছেন। এ হিসাবে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়ছেন।
সিডিবিএলের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে শেয়ার বাজারে শেয়ারশূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭৫০টি। সপ্তাহ শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৯৩৮টিতে। অর্থাৎ সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবসে ২ হাজার ১৮৮ জন বিনিয়োগকারী তাদের হাতে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স গত সপ্তাহ শেষে ১৪৪ পয়েন্ট বা প্রায় আড়াই শতাংশ কমে ৫ হাজার ৫১৭ পয়েন্টে নেমে এসেছে। গত তিন বছরের মধ্যে এটিই ডিএসইএক্সের সর্বনিম্ন অবস্থান। এর আগে সবশেষ ২০২১ সালের ৩ মে ডিএসইএক্স সূচকটি ৫ হাজার ৫১১ পয়েন্টের সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল। সূচকের পাশাপাশি লেনদেনও কমেছে। গত সপ্তাহ শেষে ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন ১৯৭ কোটি টাকা কমে ৭৬৪ কোটি টাকায় নেমে এসেছে। আগের সপ্তাহে এ বাজারের দৈনিক গড় লেনদেন ছিল ৯৬১ কোটি টাকা।
বাজারের এ অবস্থায় করণীয় নির্ধারণে গত সপ্তাহে বাজার সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। খুব শিগগিরই বৈঠকে উঠে আসা বিষয়বস্তু নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সঙ্গে বসবে ডিএসই।
ডিএসইর চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. হাফিজ মুহম্মদ হাসান বাবু বলেন, পুঁজিবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ধারাবাহিকভাবে বাজারের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করছি। যার মূল উদ্দেশ্য হলো বাজারের উন্নয়ন। তিনি বলেন, এই বাজারে যেসব নীতি হচ্ছে সেখানে ছোট ছোট অপরাধীদের ধরতে যেয়ে বড়দের জন্য সমস্যা হচ্ছে। তাই নীতি তৈরির ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের লক্ষ রাখতে হবে।
বাজারের বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ডিএসই স্টেকহোল্ডারগণ আগে বাজার উন্নয়নে ডিএসইর বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে কাজ করত। বাজারের কোনো সমস্যা বা আইপিওর বিষয়ে আমরা যে পরামর্শ দিতাম সেটা গ্রহণ করা হতো। কিন্তু এখন সেটা আর করা হয় না।
তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে যেসব সিকিউরিটিজ বাজারে এসেছে সেসব শেয়ারের অধিকাংশের অবস্থা ভালো নয়। অথচ আইপিও হচ্ছে পুঁজিবাজারের প্রাণ। সেখানেই যদি সমস্যা হয় তাহলে বাজার এগোবে না। সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের এখানে যে এসএমই মার্কেট আছে, সেটা আসলে কতটা কাজ হচ্ছে এবং সেখানের কোম্পানিগুলো কতটা ভালো সেটা যাচাই করতে হবে। আমাদের বাজারে ইক্যুইটি ছাড়া অন্য কোনো ভালো প্রোডাক্ট নাই। গত ১৫ বছর ধরেই একইভাবে চলছে। সেই সঙ্গে বাজারকে নিজস্ব গতিতে চলতে না দিলে পুঁজিবাজারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন সম্ভব হবে না।
শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন সিইও ফোরামের প্রেসিডেন্ট মো. ছায়েদুর রহমান এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, দেশে অনেক ভালো কোম্পানি আছে। এসব ভালো কোম্পানিকে ‘সুবিধা’ দিয়ে হলেও পুঁজিবাজারে আনতে হবে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আর অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর হারের পার্থক্য মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। এটা অবশ্যই বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কোনো কোম্পানির বড় ঋণ প্রয়োজন হলে তার একটি অংশ পুঁজিবাজার থেকে নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। পুঁজিবাজারকে গতিশীল করতে, সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এসব বিষয় বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।