ঢাকা (দুপুর ২:৩৭) রবিবার, ২২শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

Join Bangladesh Navy


কোরআন ও হাদিসের আলোকে ইসলাম এবং মুসলমানের পরিচয়। -হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী

ইসলাম ধর্ম ২৫৬ বার পঠিত
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

মেঘনা নিউজ ডেস্ক মেঘনা নিউজ ডেস্ক Clock সোমবার দুপুর ০১:৪৮, ২১ অক্টোবর, ২০২৪

ইসলাম কী : ইসলাম শব্দের অর্থ- আত্মসমর্পণ করা। অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গরূপে কোরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনার জন্য আত্মা তথা মনকে সমর্পণ করা। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য ধর্ম মানেই ইসলাম। অন্য কোনো ধর্মের মাধ্যমে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা অসম্ভব। এরশাদ হচ্ছে-‘আল্লাহর কাছে মনোনীত ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৯)।

ইসলামের উপমা: ইসলাম হলো একটি তাবুর ন্যায়। তাবু যেমন তার ভেতরের মানুষকে রোদের সময় রোদ, শীতের সময় ঠান্ডা, প্রচন্ড বাতাসের সময় ধুলোবালি থেকে রক্ষা করে, তদ্রুপ ইসলাম মানুষকে পরকালীন আজাব থেকে রক্ষা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যারা কোরআন-সুন্নাহর পরিপূর্ণ অনুসরণ করে, তারাই প্রকৃত মুসলমান। এরশাদ হচ্ছে-‘হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করো।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)। এ আয়াতে প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তিকে ইমান আনার পর ইসলামের বিধান তথা কোরআন ও সুন্নাহ অনুসরণের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় শুধু মুমিন তথা আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ব্যক্তিকে প্রকৃত মুসলমান বলা যাবে না।

প্রকৃত মুসলমানের দৃষ্টান্ত: প্রকৃত মুসলমানের দৃষ্টান্ত হলো- একটি দেয়ালঘড়ির ন্যায়। যার সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিটের কাঁটা এবং ঘণ্টার কাঁটা আছে। ব্যাটারিতে আছে পূর্ণ চার্জ। বেতারকেন্দ্রের সময়ের সঙ্গে এর সময়ের মিল রয়েছে। এ ধরনের ঘড়ির সময় দেখে কেউ যদি কোনো মিটিংয়ে যোগ দিতে চায়, তাহলে সে প্রস্ততি নিয়ে ঠিক সময়ে মিটিংয়ে উপস্থিত হতে পারবে। ইমানও তেমনই বিষয়। ইমান গ্রহণ করার পর ঘণ্টার কাঁটার মতো ফরজ, মিনিটের কাঁটার মতো ওয়াজিব এবং সেকেন্ডের কাঁটার মতো সুন্নতের অনুসরণ করতে হবে। জীবনের কোনো অবস্থাতেই ফরজ-ওয়াজিব বাদ দেওয়া যাবে না। ঘণ্টা কিংবা মিনিটের কাঁটা যদি কিছু সময়ের জন্য থেমে যায়, তাহলে ঘড়ি যেমন সঠিক সময় নির্ণয় করতে পারে না, ঠিক তেমনি ফরজ বা ওয়াজিব যদি ছুটে যায়, তাহলে ইমানও ব্যক্তিকে পূর্ণ ইমানদার বানাতে পারবে না। ঘড়ির ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে গেলে যেমন পুনরায় সচল করার জন্য নতুন ব্যাটারি লাগাতে হয়, তদ্রুপ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানুষের মনের অবস্থার পরিবর্তন হয়। সেজন্য মাঝেমধ্যে আল্লাহর অলিদের মজলিসে অথবা ওয়াজ মাহফিলে গিয়ে মনের ব্যাটারিতে চার্জ দিয়ে ইমান তরতাজা করতে হয়। পাশাপাশি ধর্মীয় বই পাঠের অভ্যাস করে নিতে হয়। তাহলেই প্রকৃত মুসলমান হওয়া যায়, আখেরাতের প্রস্ততি নেওয়া সম্ভবপর হয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সন্তষ্টি অর্জন করে হাজির হওয়া যায় আল্লাহর দরবারে।

নামধারী মুসলমানের পরিচয়: যারা ইসলামের কিছু বিধান পালন করে আর কিছু পালন করে না, যেমন- নামাজ পড়ে, তবে নিয়মিত পড়ে না; রোজা রাখে, সবগুলো রাখে না; অন্যান্য আমলের বেলায়ও কিছু করে, কিছু করে না; আবার করলেও নিয়মিত করে না- এদের দৃষ্টান্ত হলো, তারা এমন দেয়ালঘড়ির ন্যায়, যার সেকেন্ডের কাঁটা, মিনিটের কাঁটা, ঘণ্টার কাঁটা আছে, কিন্তু ঘড়ির সময়ের সঙ্গে বেতারকেন্দ্রের সময়ের কোনো মিল নেই। এমন ঘড়ি দূর থেকে ঘড়ি মনে হলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না এর দ্বারা। এ ধরনের ঘড়ির সময় দেখে কোনো কাজ করলে বিভ্রান্তির স্বীকার হতে হয়। তদ্রুপ যে ব্যক্তি ইসলামের সকল বিধান মানে না, সে দূর থেকে দর্শকের দৃষ্টিতে মুসলমান; কিস্তু ইসলামের দৃষ্টিতে প্রকৃত মুসলমান নয়।

প্রকৃত মুসলমানের গুণাবলি: কোরআনে কারিমের বিভিন্ন স্থানে মহান রাব্বুল আলামিন প্রকৃত মুসলমানের বেশ কয়েকটি গুণ বর্ণনা করেছেন। যেমন এরশাদ হচ্ছে-‘যাদের সামনে আল্লাহর কথা স্মরণ করা হলে তাদের অন্তর ভীত হয়, যারা তাদের বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ করে, যারা নামাজ কায়েম করে ও আমি যা দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে।’ (সুরা হজ : ৩৫)। এ ছাড়াও সুরা মুমিনুনের প্রাথমিক আয়াতগুলোতে আল্লাহতায়ালা প্রকৃত মুসলমানের গুণ এভাবে বর্ণনা করেছেন-‘যারা নিজেদের নামাজে নম্র, যারা অনর্থক কথাবার্তায় নির্লিপ্ত, যারা জাকাত প্রদান করে।’ (সুরা মুমিনুন : ২-৪)।

মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যাবতীয় কাজ-কর্মে আল্লাহর হুকুম-আহকাম মেনে চলাই হচ্ছে মানব সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য। আর তাঁর হুকুম-আহকাম পালনের আমলই হলো ইবাদত। আল্লাহতায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁরই ইবাদত করার জন্য। দুনিয়াতে মানুষের আগমন ও জীবনের লক্ষ্য হলো, আল্লাহতায়ালার বিধিবিধানের বাস্তবায়ন তথা তাঁর ইবাদত-বন্দেগি করা। এরশাদ হচ্ছে-‘আর জিন ও মানবজাতিকে কেবল আমার ইবাদত করার জন্য সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা জারিয়াত : ৫৬)। মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে আগমনের কারণে যে প্রক্রিয়ায় ইবাদত তথা সৃষ্টির উদ্দেশ্য সফল হবে, তা হলো- প্রথমত আল্লাহতায়ালাকে রব হিসেবে মেনে নিয়ে তাঁর দাসত্ব স্বীকার করা। এরপর তাঁর নির্দেশ মেনে তাঁরই পরিপূর্ণ আনুগত্য করা। তারপর সর্ববিষয়ে তাঁর সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করা অর্থাৎ আল্লাহতায়ালাকে রব বলে স্বীকার করা, অন্য কাউকে তাঁর সঙ্গে শরিক না করা।

ইবাদত কী : আরবি ‘ইবাদত’ শব্দটি ‘আব্দ’ শব্দ হতে এসেছে। ‘আব্দ’ শব্দের অর্থ হলো দাস বা গোলাম। সুতরাং ইবাদত মানে হলো আল্লাহর গোলামি বা বন্দেগি করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর নির্দেশিত পথ ও মতে জীবন পরিচালনা করা। দুনিয়াতে যে ব্যক্তি আল্লাহর গোলামি করবে, সে-ই প্রকৃত সফলকাম। মানুষ যখন কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশ পালন করে ইবাদত করতে ব্যর্থ হয়, বুঝতে হবে আল্লাহর বান্দা হিসেবে দুনিয়াতে প্রতিটি মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্যই তখন ব্যর্থ। ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্ক গভীর হয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-সূত্রে বর্ণিত হাদিসে কুদসিতে আল্লাহতায়ালা বলেন-‘হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতে আত্মনিয়োগ করো, আমি তোমার হৃদয়কে অভাবমুক্ত করে দেবো এবং দারিদ্র বিমোচন করে দেবো। আর যদি তা না করো, তাহলে কর্মব্যস্ততা দ্বারা তোমার হাত ভরে দেবো। দারিদ্রও দূর করবো না।’ (আল মুসনাদ : ১৬/২৮৪)। মোল্লা আলি কারি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন-‘এর অর্থ হলো, তুমি তোমার রবের ইবাদত করার সময় মন-দিল উপস্থিত রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকো।’ (মিরকাতুল মাফাতিহ : ৭/২৬)।

ইবাদত সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা: মানুষ মনে করে- কোরআনে কারিমের নির্দেশ পালনে নামাজ আদায় করা, রোজা ও হজ পালন করা, জাকাত দেওয়া, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার, কোরআনে কারিম তেলাওয়াত করার নামই ইবাদত। না, ইবাদত মানে তা নয়। মিথ্যা কথা বলে, সুদ-ঘুষে জড়িত থেকে, লোক দেখানো ইবাদত করে, বেহায়াপনা, চোগলখুরি, হিংসা-বিদ্বেষ ও মুনাফেকির সঙ্গে লিপ্ত থেকে কেবল নামাজ-রোজার মতো অন্যান্য আমল করার নাম ইবাদত নয়। কোরআন-সুন্নাহর নিষেধগুলো মেনে রাব্বে কারিমের যাবতীয় আদেশ পালন করা হলো প্রকৃত ইবাদত তথা বন্দেগি। কারণ ইবাদত হলো আল্লাহতায়ালার হুকুম-আহকাম যথাযথ পালন করা।

এরশাদ হচ্ছে-‘আর রাসুল তোমাদেরকে যা দেন (নিয়ে এসেছেন), তা গ্রহণ করো এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো এবং আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সুরা হাশর : ৭)। তাই আমাদেরকে আত্মপরিচয় সম্বন্ধে অবগত হতে হবে। এরপর নিজেদের সৃষ্টির মূল লক্ষ্য ইবাদত করার ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কোনোক্রমেই যেনো আমাদের কোনো আমল লোকদেখানোর জন্য না হয়; বরং একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি হাসিলই যেনো হয় আমাদের জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্য-মাকসাদ। রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে কবুল করে নিন। আমিন।

লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী, সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী মাজার জামে মসজিদ সিলেট।




শেয়ার করুন


পাঠকের মতামত

মেঘনা নিউজ-এ যোগ দিন

Meghna Roktoseba




এক ক্লিকে জেনে নিন বিভাগীয় খবর



© মেঘনা নিউজ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
Developed by ShafTech-IT